শ্রীদ্বৈপায়ন সেনের গবেষণাপত্রের আধারে লিখিত
===============================
২৯শে জানুয়ারী, ১৯০৪। বরিশালের
মইস্তারকান্ডি গ্রামে অচ্ছুৎ চন্ডাল নমশূদ্রের ঘরে জন্ম হয় যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের।
বাবা রামদয়াল আর মা সন্ধ্যাদেবীর আদরের ছোটো ছেলে ষষ্ঠ সন্তান হিসাবে। আদরের ছেলে,
বুদ্ধিমান বংশের মুখ উজ্বল করতে পারে কিন্তু পেটই চলেনা তার আবার পড়াশোনা। গ্রামের
ইস্কুলেও ঠিকমত পড়াশোনা চালাবার খরচ যুগিয়ে উঠতে পারতেন না। পরবর্তীকালে এই ছেলেই
হয় ইংরেজ আমলের বাংলার ছোটোলেকের সবচেয়ে বড় গর্ব তার বাগ্মীতার এবং স্পষ্টবাদিতার
জন্য।
বাংলার ইতিহাসে জাতপাতের সমস্যা নিয়ে
কোনোদিনই সেরকম আলোচনা হয়নি। বাংলার নবীরা সেই কবে থেকে গর্ব করে আসছে এখানে আমরা
সব সেকুলার, কমিউনিস্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই জন্যই বোধহয় যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলকে
স্মরন করা সবার পক্ষেই একটু চাপের ব্যাপার হয়ে যায় তার থেকে যোগেন মন্ডলকে চেপে
যাওয়া অনেক সহজ এবং বুদ্ধিমানের কাজ।
যোগেন মন্ডলের ছেলেবেলা স্বদেশী
আন্দোলনের যুগ। ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলন, যার নেতৃত্বে ছিল
উচু জাতের বর্ণহিন্দুরা। তারা চাইছিল মুসলিম আর ছোটোলোক নীচু জাতের কৃষিজীবী
মানুষগুলোকে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে খেপিয়ে দিতে। কিন্তু তা হলনা। ছোটোলোকরা
ভদ্দরলোক বাবুদের কথায় নাচল না। এই সময় বেড়ে উঠছিলেন যোগেন মন্ডল। আত্মীয়স্বজনদের
সাথে প্রতিদিনের কথাবার্তা আর নিজের জাতকে প্রতি পদে পদে অনুভব করে। জলে আধডোবা
বরিশালের গ্রামে গ্রামে নৌকা করে স্কুলে পড়তে যাওয়া, ফিরে এসে ক্ষেতের কাজ আর রাতে
লন্ঠনের আলোতে পড়াশোনা করা – এই ছিল তার জীবন। এভাবেই যোগেন মন্ডলের ম্যাট্রিক
পর্যন্ত শিক্ষা।
অবশেষে ১৯২৪ সালে আত্মী্যদের আর্থিক
সহায়তায় নির্ভর করে তিনি ভর্তি হলেন বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে। বিষয় – ভারতীয় প্রশাসন।
কলেজে তিনি অশ্বিনি কুমার দত্তের সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হন। এই সংগঠনের কাজ
ছিল কৃষকদের দারিদ্র এবং সাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে। এই সময়েই, ১৯২৬ সালে
যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল তার নমশূদ্র ছাত্রের প্রতি আর একজন বর্ণহিন্দু ছাত্রের
ব্যবহারের প্রতিবাদে গড়ে তোলেন এক প্রচার আন্দোলন। নমশূদ্র ছাত্রের আপরাধ – মন্দিরে প্রবেশ। ঐ
বছরই আগাইলঝড়া গ্রামে যোগেন মন্ডলের বক্তা হিসাবে প্রকৃত আত্মপ্রকাশ। বক্তব্যের
বিষয় – ছোটোলেকের এক হওয়ার প্রয়োজন। বিশের কোঠায় পা দেওয়ার সময় থেকেই যোগেন মন্ডল
ছোটোলোকদের অবস্থা নিয়ে কথা বলা শুরু করেন। ঐ বছরই অর্থাৎ ১৯২৬ সালেই তিনি কলেজ
থেকে গ্র্যাজুয়েট হন। এর বেশ কিছু পরে, ১৯২৯ সালে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন ক্যালকাটা ল
কলেজে।
ল কলেজে পড়ার দিনগুলিতে উনি থাকতেন
প্যারীমোহন দাশের বাড়িতে। খরচা চলত প্যারীমোহন দাশের ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে আর প্রুফ
রিডিং করে। ল কলেজের দিনগুলিতে তারতবর্ষ ছিল উত্তাল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময়। সে
সময় ইংরেজ প্রধানমন্ত্রী রামসে ম্যাকডোনাল্ড ঘোষনা করেছেন কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড।
কমিউনাল অ্যাওয়ার্ডের উদ্দেশ্য ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় উঠে আসা জাতপাত এবং
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নের সমাধান, যা সেই সময়কার
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব করতে ব্যার্থ হয়েছিলেন। যোগেন মন্ডল দেখছিলেন গোলটেবিল বৈঠকের ব্যার্থতা আর
তার পরে পুনা চুক্তি আম্বেদকর আর গান্ধীর মধ্যে। পুনা চুক্তির মাধ্যমে গান্ধী
একরকম বলা যায় নিগৃহীত করছিলেন আম্বেদকারকে তার জয়েন্ট ইলেকটোরেট আর তার মধ্যে
সংখ্যালঘুদের জন্য আসন সংরক্ষন ফর্মুলা মানার জন্য। যোগেন মন্ডল এই সব দেখছিলেন। ল
কলেজের দিনগুলিতে এবং তার পরের সময়ে তিনি ভাবছিলেন কি করা যায়। ১৯৩৪ সালে ল পাশ
করার পর তিনি অ্যাপ্রেন্টিস হিসাবে কাজ শুরু করেন বিশিষ্ট আইনজীবি চন্দ্রমোহন
চক্রবর্ত্তীর কাছে ক্যালকাটা স্মল কসেস কোর্টে। ১৯৩৬ সালে তিনি স্বাধীনভাবে
ওকালতির প্র্যাকটিস শুরু করেন ঐ একই কোর্টে। অবশ্য এর আগেই যোগেন মন্ডল বরিশালে
ফিরে এসেছেন এবং জেলা কোর্টে যোগদান করেছেন।
বরিশালের মফস্বলের ফেরার পিছনে কাজ
করছিল গরীব অচ্ছুৎ কৃষিজীবিদের সাথে আরো কাছাকাছি থাকা, তাদের নিয়ে কাজ করার
ভাবনা। তার সমসাময়িক উকিল বন্ধুদের মধ্যে তার ব্যাতিক্রমী প্রয়াস গরীব কৃষিজীবিদের
কেস লড়া (প্রায় বিনে পয়সায়) সবার চোখ টানল। বরিশালের চাষাভূষার মধ্যে যোগেন
মন্ডলের নাম ছড়িয়ে গেল যার ফলশ্রুতি প্রথমে বরিশাল সদর বোর্ডে এবং পরে বরিশাল জেলা
বোর্ডে তার নির্বাচন। হিন্দু মুসলিম উভয়ের মধ্যেই তাঁর জনপ্রিয়তা এতটাই ছিল যে
তাকে প্রায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে দেখতে সকলেই চাইছিলেন। কিন্তু যোগেন মন্ডল এই পদ
প্রত্যাখ্যান করেন। বরিশালের এই বিপুল জনপ্রিয়তাই তার ভবিষ্যত রাজনৈতিক জীবনের
সূত্রপাত ঘটিয়েছিল।
রাজনৈতিক জীবন
১৯৩৭ সালে প্রভিন্সিয়াল অ্যাসেম্বলি
নির্বাচনে যোগেন মন্ডল একমাত্র তফশিল জাতির মানুষ হিসাবে নির্বাচিত হন। এর কারন
ছিল উত্তর পূর্ব বরিশালের আপামর চন্ডাল অচ্ছুৎ এবং প্রগতীশীল হিন্দু ভোটারদের
অকুন্ঠ সমর্থন। যোগেন মন্ডলের প্রতিদ্বন্দী ছিলেন সরল কুমার দত্ত, অশ্বিনি কুমার দত্তের
ভ্রাতুষ্পুত্র এবং উত্তরসূরী। নির্দল হিসাবে নির্বাচিত যোগেন মন্ডল ফজলুল হকের
মন্ত্রীসভার বিরোধী আসনে বসলেন। ফজলুল হকের মন্ত্রীসভা সাধারন মানুষের মধ্যে
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরন কিছু মাত্রাতে হলেও করেছিল। আর যোগেন মন্ডল তুলে ধরতেন
সরকারের সমালোচনা। সমালোচনা করতেন প্রাথমিক শিক্ষা, কৃষি ঋণ এবং সরকারের বিভিন্ন
কমিটি ইত্যাদিগুলিতে সিডিউল কাস্টের প্রতিনিধিত্বের অভাব ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে।
মূলত তাকে কেন্দ্র করেই আইনসভায় তৈরি হয় একটি গ্রুপ – ইন্ডিপেনডেন্ট সিডিউল
কাস্ট পার্টি। এর কাজ ছিল এই সমস্ত ইস্যুগুলিতে সিডিউল কাস্টের পক্ষে সরকারের ওপর
চাপ সৃষ্টি করা। যোগেন মন্ডল এই গ্রুপের সম্পাদক ছিলেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যোগেন মন্ডল বোস
ভাইদের অর্থাৎ শরৎ এবং সুভাষ বোসের সাথেও যথেষ্ঠ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। উভয়েরই
রাজনৈতিকভাবে বামপন্থী হিসাবে পরিচিতি ছিল এমনকি কংগ্রেসের ভেতরেও। সুভাষ বোসতো
১৯৪০ সালে যোগেন মন্ডলকে কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে সমর্থনও করেছিলেন। কিন্তু এই
সম্পর্কে ছেদ পড়ে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে। সুভাষ বোসের সাথে গান্ধীর বিরোধ চরমে পৌছায়
এবং সুভাষ দেশত্যাগী হন আর শরৎ বোসের ঠাই হয় জেলে।
ইতিমধ্যে যোগেন মন্ডল প্রভাবিত হন
আম্বেদকারের ভাবনায়। এছিল তাঁর নিজের রাজনৈতিক ভাবনার উত্তরন বা এক বড় পরিবর্তন।
১৯৪০ এর দশকের প্রথম দিকে যোগেন মন্ডল বেশ কয়েকবার দেখা করেন আম্বেদকারের সাথে। ১৯৪৩
সালে যোগেন মন্ডল আম্বেদকারের অল ইন্ডিয়া সিডিউল কাস্ট ফেডারেশনের বাংলা শাখার
প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রানপুরুষ হিসাবে কাজ শুরু করেন। ১৯৪৩এই মুসলিম লীগ এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের
কোয়ালিশন সরাকারের কৃষি এবং সমবায় মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহন করেন। সরকার
প্রতীক হয়ে ওঠে মুসলিম এবং সিডিউল কাস্টের মেলবন্ধনের – এক ধারনার যার বীজ
নিহিত ছিল বাংলার বুকেই। কিন্তু সময়টা তখন ডামাডোলের। একদিকে বিশ্বযুদ্ধ,
জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, আকাল, মানুষের তৈরি করা দুর্ভিক্ষ, আর ব্রিটিশ শাসনের
মৃত্যুঘন্টা বেজে গেছে। শুরু হয়ে গেছে ক্ষমতা হস্তান্তরের হিসাব নিকাশ। এরকম এক
সময়ে দাঁড়িয়ে যোগেন মন্ডলের কাজ তাঁর ভাবনাকে প্রতিফলিত করে। যোগেন মন্ডল এই সময়ে
ক্রমাগত, হয়তোবা খানিকটা একাকীও লড়ে গেছেন ছোটোলোকদের আর কৃষিজীবীদের নিয়ে। উনি
লড়ে গেলেন কংগ্রেসের সাথে সেই কংগ্রেস যে ছিল বর্ণহিন্দুদের দল আর হিন্দু মহাসভার
রাজনীতির বিরুদ্ধে।
১৯৪৬ সালে, যখন আম্বেদকার তার নিজের ঘর
বম্বে প্রেসিডেন্সি থেকে আইনসভায় যেতে পারলেন না, যোগেন মন্ডল বাংলার বুকে
আম্বেদকারের জন্য সমর্থন তৈরি করতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ইতিহাসের পাতায় এই ঘটনাটি
বিশেষভাবে অনুল্লেখিত বা অনালোচিত থেকে গেছে। অথচ একথা বলা অত্যুক্তি হবেনা যে
যোগেন মন্ডলের এই সময়ের কার্যকলাপই আম্বেদকারকে প্রেরনা এবং রসদ যুগিয়েছিল
পরবর্তীকালে সংবিধান রচনার কাজে। যদিও শেষ পর্যন্ত আম্বেদকারের কংগ্রেসের সাথে
মিলিতভাবে কাজ করার সিদ্ধান্তের ফলেই হয়তো ঘটনাটি তার প্রাপ্য গুরুত্ব পায়নি।
১৯৪৬ সালেই যোগেন মন্ডল ছিলেন একমাত্র
সিডিউল কাস্ট প্রার্থী যিনি সাধারন নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন সিডিউল কাস্ট
প্ল্যাটফর্ম থেকে। সুরাবর্দীর মন্ত্রীসভায় তিনি মন্ত্রী হিসাবে কাজ করেন। ৪৬এর
অগাস্টের ভয়াবহ দাঙ্গার পরও যোগেন মন্ডলের মন্ত্রীসভা থেকে ইস্তফা না দেওয়া নিয়ে
সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এদের মধ্যে তৎকালীন সিডিউল কাস্টের নেতৃবৃন্দও ছিলেন। যোগেন
মন্ডল এই সমালোচনার উত্তরে সিডিউল কাস্টকে এই দাঙ্গা থেকে দুরে থাকতে বলেন। কারন – এ দাঙ্গা হিন্দু
মুসলিমের, সিডিউল কাস্টের এতে কোনো লেনাদেনা নেই। যোগেন মন্ডল কংগ্রেস এবং হিন্দু
মহাসভাকে সরাসরি অভিযুক্ত করেন সিডিউল কাস্টকে প্ররোচনা দিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে
খেপিয়ে তোলার চেষ্টার জন্য। অবশ্য তাঁর মতামত এবং বক্তব্য তৎকালীন হিন্দু
কাগজগুলিতে প্রকাশিত হয়না।
এই পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে জিন্না যোগেন
মন্ডলকে মনোনীত করেন মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে বৃটিশরাজের থেকে ক্ষমতা হস্তান্তর
পর্বে আইনমন্ত্রী হিসাবে। এই পদে যোগেন মন্ডল শরৎ চন্দ্র বোস, সুরাবর্দীদের সাথে
দায়িত্ব পালন করেন যদিও স্বল্প সময়ের জন্য। যোগেন মন্ডল বাংলা ভাগের বিরোধীতা করেন
বহুবিধ কারনে যার মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল দেশভাগের ফলে সিডিউল কাস্ট এবং তার সদ্য
তৈরি হওয়া চেতনার এবং সংগঠনের উপর নেতিবাচক প্রভাব। কিন্তু অখন্ড বাংলার কথা শোনার
লোক সে সময় বড় একটা ছিলনা। অনিবার্যভাবেই দেশভাগ হলো আর তারই সাথে সত্য প্রমানিত
হলো যোগেন মন্ডলের দুঃস্বপ্ন। পশ্চিমবঙ্গে সিডিউল কাস্ট হয়ে দাঁড়ালো হিন্দুত্বের
লেজুড় আর পূর্ববঙ্গে মুসলিমের।
স্বাধীনতা?
বরিশাল পূর্ব পাকিস্থানের অন্তর্গত
হওয়ার কারনে যোগেন মন্ডল পাকিস্থান সরকারে আইন এবং শ্রমমন্ত্রী হিসাবে যোগদান
করেন। পাকিস্থান আইনসভার উদ্বোধনী ভাষন দেন যোগেন মন্ডল। এই ভূমিকায়্ যোগেন
মন্ডলের ভূমিকা ছিল একইরকম নিরলসভাবে সিডিউল কাস্ট, শ্রমিক এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা
সুনিশ্চিত করা। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই যোগেন মন্ডলের পাকিস্থান সরকারের প্রতি
মোহভঙ্গ হয়। যোগেন মন্ডল ভেবেছিলেন পাকিস্থানে সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তার সাথে থাকতে
পারবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হলনা। স্বাধীনতার পর এপার এবং ওপার বাংলায় দাঙ্গায়
জর্জরিত ছোটোলোকরা তাদের চেতনা, রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার রক্তাক্ত সমাধির
উপরে দাঁড়িয়ে, অবশেষে ১৯৫০ সালে ভগ্ন হৃদয়ে এক পরজিত সৈনিকের মতন যোগেন মন্ডল ফিরে
আসেন কলকাতায়।
এরপর আর কোনোদিন যোগেন মন্ডল কোনো পদ বা
দায়িত্বগ্রহন করেননি। যদিও এরপরও বিভিন্নবার উনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দীতা করেছেন
বিভিন্ন দল এবং মঞ্চের হয়ে এমনকি কংগ্রেসের হয়েও – যাকে তিনি এযাবৎকাল
সমালোচনাই করে এসেছেন। পাকিস্থান সরকারের থেকে তাঁর ইস্তফা তুমুল সমলোচিত হয়। লোকে
প্রচার করে এ তাঁর এবং তাঁর রাজনৈতিক দুরদৃষ্টির ব্যার্থতা হিসাবে। এরপর তিনি বাস
করতেন এক বস্তিঘরে – এক মহান জনপ্রিয় জননেতার সাথে অসামন্জস্যপূর্ন
ভাবেই।
সে সময়ে পূর্ব বাংলা থেকে আগত উদ্বাস্তু
শরনার্থীরা ছুটে বেড়াচ্ছেন এক ক্যাম্প থেকে আর এক ক্যাম্পে। সরকার তাদের পাঠাতে
চাইছে সুন্দরবন, আন্দামান আরো এরকম কত জায়গায়। কারন এখানে জমির অভাব। না ঘরকা না
ঘটকা মানুষগুলি বেশিরভাগই ছিল নীচু জাত – সিডিউল কাস্ট। সে
মানুষগুলির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন যোগেন মন্ডল। তাদের কথা বলতে গিয়ে সেসময় একাধিক বার
জেল পর্যন্ত যেতে হয়েছে তাঁকে। যোগেন মন্ডল প্রথমে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির
ইউনাইটেড সেন্ট্রাল রিফিউজি কাউন্সিলে যোগদান করেন। কিন্তু আদর্শগত এবং কৌশলগত
নানা বিরোধের কারনে এই সংগঠনের সাথে তিনি দীর্ঘ সময় যুক্ত থাকতে পারেননি। স্বাধীন
ভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার তাগিদে সে সময় ইস্টার্ন ইন্ডিয়া রিফিউজি কাউন্সিলের পত্তন
করেন।
উদ্বাস্তু আন্দোলনের সাথে সাথেই নতুন
ভারতীয় রাষ্ট্রের সিডিউল কাস্টের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা এবং যথাযথ রূপায়নের
সাথে। এই সূত্রে তিনি সভাপতি ছিলেন সিডিউল কাস্ট অ্যান্ড ট্রাইব ওয়েলফেয়ার
কাউন্সিলের। একই সাথে তিনি আম্বেদকারের রিপাবলিকান পার্টিরও পূর্ব ভারতের দায়িত্বে
ছিলেন। এই সূত্রে উল্লেখ্য যে ১৯৬৫ সালে লোকুর কমিশনের সুপারিশের বিরোধিতা করেন।
কমিশনের সুপারিশ ছিল নমশূদ্র এবং মাহার-দের, যাদের মধ্যে স্বয়ং আম্বেদকার এবং
যোগেন মন্ডল নিজে পড়তেন, সিডিউল কাস্টের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া।
৫ই অক্টোবর, ১৯৬৮ যোগেন মন্ডল দেহত্যাগ
করেন। সে সময় তিনি বনগাঁয় নির্বাচন প্রচার করছিলেন। যোগেন মন্ডলের সাথেই শেষ হয়ে
গেল নীচু জাতের মানুষদের লড়াই তাদের কথা বলার এক অধ্যায়ের। রাষ্ট্রীয় ইতিহাস তাঁকে
মনে রাখতে চায়নি। রাষ্ট্র তাঁর কোনো মূর্তি বানায়নি, রাস্তার নামকরন করেনি।
কলকাতার উপকন্ঠে শহরতলিতে এবং কল্যানিতে তাঁর নামাঙ্কিত দুটি স্কুল আছে আর
নাহাটাতে একটি কলেজ। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল স্মৃতি রক্ষা কমিটি প্রতি বছর তাঁর
জন্মদিন পালন করেন। যোগেনন্দ্রনাথ মন্ডল একমাত্র সন্তান জগদীশচন্দ্র মন্ডল
সম্প্রতি যোগেন মন্ডলের কাজ ও সিডিউল কাস্টদের বিষয় নিয়ে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য
লেখাপত্র প্রকাশ করেছেন। আ্জকের ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পটভূমিকায়, যোগেন মন্ডলের
নীচু জাত ও মুসলিমের মেলবন্ধনের রাজনীতি নতুনভাবে প্রাসঙ্গিকতা লাভ করছে।
স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় কেটে গেছে।
যোগেন মন্ডল অতীত হয়ে গেছেন। তবু তাঁর তোলা প্রশ্নগুলি, তাঁর ভাবনা, নীচু জাতের
শোষন – এগুলি কি অতীত হয়ে গেছে? হয়তো সময়ের সাথে সাথে কিছু প্রশ্নের মীমাংসা হয়েছে,
কিছুবা পরিবর্তিত হয়ে অন্য নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আজকের যুগে যখন
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি আবর্তিত হচ্চে প্রশ্ন শিল্প, কৃষি, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম নিয়ে
তখন যোগেন মন্ডলকে বড় প্রাসঙ্গিক মনে হয়। জানতে ইচ্ছে করে যদি তিনি আজ বেঁচে
থাকতেন তবে তিনি এব্যাপারে কি বলতেন।
অনুবাদকের বক্তব্য
------------------
এই লেখাটি শ্রীদ্বৈপায়ন সেনের
গবেষনাপত্রের আধারে লিখিত। গবেষকের সাথে আমার ব্যক্তিগত আলাপ নেই বা অনুবাদ
সম্পর্কে কোনো আলচনা করার কোনো সূযোগ নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়
কথিত সমাজবিজ্ঞান এবং তার পরিভাষা সম্পর্কে প্রায় আনাড়ি। আমি এই লেখাটা অনুবাদ
করেছি বা হয়তো খানিকটা লিখেছিই বলা যেতে পারে দুটো বিষয়ের প্রেক্ষিতে। প্রথমত,
চেতনা লহর ও তার পাঠক আর দ্বিতীয়ত ছোটোলোকের ইতিহাসের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা মানে
হাম কিসিসে কম নেহি। ভদ্দরলোকদের আমি ঘেন্না করি এবং এড়িয়ে চলি, তারাও আমাকে
সরাসরি বিশেষ ঘাটায় না। স্বাভাবিকভাবেই, ভদ্দরলোকদের ভাষা বা পরিভাষা কোনোটার
প্রতিই আমার কোনো দায় নেই বরং যত পারবো ওগুলোর তেরটা বাজানোরই চেষ্টা করি।
অতএব খারাইলোটা কি? শ্রীসেন আমার
অনুবাদটি পড়েননি বা বলা ভালো সূযোগ পাননি তবে আমার আশঙ্কা আছে যে উনি হয়তো এই
লেখাটিকে ওনার কাজের অনুবাদ বলতে অসুবিধা বোধ করতে পারেন। এই লেখার দায় দায়িত্ব
এবং অপদার্থতা বা ছোটোলোকামি যা আছে সেটা সবটাই আমার আর কৃতিত্ব পুরোটাই চেতনা লহর
আর শ্রীদ্বৈপায়ন সেনের। এঁরা অনেক বড়ো মাপের মানুষ বলে ভরসা রাখি ভালো না লাগলেও
প্রশ্রয় পাবো।
যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলকে নিয়ে চেতনা লহর
ধারাবাহিক কাজ করবেন বলে শুনেছি, সেই প্রচেষ্টাতে একটা ইট গাঁথতে পারলেই আমি
সার্থক।