ডা: বাবাসাহেব আম্বেদকারের এই সাক্ষাতকারটি
বিবিসিতে প্রচারিত হয় ৩১/১২/১৯৫৫ সালে। আজকের দিনে দলিত আন্দোলন, হিন্দুত্ব,
সংরক্ষন এবং গান্ধীবাদের বিভিন্ন সংমিশ্রন যখন ২০১৪র লোকসভা ভোটের আগে পরে দেখা
যাচ্ছে তখন সেই মানুষটি যিনি এখনও দলিতদের কাছে গর্ব তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক আশা
ভরসার রক্ত মাংসের ছবি, তিনি কি ভাবতেন মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে? কেমনভাবে একজন
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসাবে তিনি দেখেছিলেন গান্ধীকে? এই বিনির্মান বা অতিনির্মানের
যুগে দাঁড়িয়েও শুধু তার কথাটুকু শুনলেই মনে হবে এ যেন আজকের কথা... এ ইতিহাস হয়তো
লেখা হবে না পাঠ্য পু্স্তকে। চেতনা লহরের সূত্রে কোথাও কেউ মনে করুন এই ইতিহাসকে
সেকথা ভেবেই সাক্ষাৎকারটির মোটামুটি সৎ একটা অনুবাদ করা হল।
গান্ধীর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় ১৯২৯ সালে, এক
বন্ধুর মাধ্যমে। আমাদের এক বন্ধু মি: গান্ধীকে অনুরোধ করেন আমার সাথে আলাপ করার
জন্য। মি: গান্ধী আমাকে চিঠি লেখেন এবং আমার সাথে দেখা
করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমিও যাই ওনার সাথে দেখা করতে। সে সময়টা ছিল ১৯২৯, প্রথম
গোলটেবিল বৈঠকের ঠিক আগে। প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে গান্ধী আসেননি। কিন্তু তারপর
দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে উনি আসেন। সে সময় উনি প্রায় পাঁচ ছয় মাস ছিলেন। সে সময় আমি
ওনার সাথে অনেকবার দেখাও করেছিলাম এবং রাজনৈতিকভাবে মুখোমুখিও হয়েছিলাম। এরপর পুনা
চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই উনি আমাকে দেখা করতে অনুরোধ করেন। তখন উনি জেলে। আমি দেখা
করেছিলাম। এই সমস্ত সময়গুলিতেই আমি গান্ধীর সাথে দেখা করেছিলাম। এ প্রসঙ্গে একটা কথা আমি বলতে চাই – আমি
গান্ধীকে দেখেছি তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসাবে। কখনো কখনো আমার মনে হয় এভাবে
দেখাতে আমি ওনাকে অনেকের চেয়ে অনেক ভালো চিনতে পেরেছি। গান্ধীকে আমি দেখতে পেয়েছি
একজন মানুষ হিসাবে, তার ভেতরের মানুষটাকে। যারা তার কাছে গিয়েছিলেন শিষ্য হিসাবে
তাঁরা তাঁর সেই রূপ কখনোই দেখতে পাননি। তাঁরা শুধু তাঁর বাইরের রূপটুকুই দেখেছে
যেখানে তিনি মহাত্মা। আমি আবার বলব আমি মহাত্মা গান্ধী নয় মানুষ গান্ধীকে দেখেছি
যা তাঁর শিষ্যগন দেখতে পাননি।
বিবিসি – আপনি কিভাবে আপনার দেখাকে ব্যাখ্যা
করবেন?
আ: স্বীকার করতে অসুবিধা নেই যে আমি বেশ খানিকটা
অবাকই হই যখন দেখি পৃথিবীর লোকেরা, বিশেষত পাশ্চাত্যের পন্ডিতরা যখন গান্ধীকে নিয়ে
এতটা মাতামাতি করছেন। আমি এটা বুঝতে পারিনা। এটুকু বলতে পারি, ভারতের ইতিহাসের
ক্ষেত্রে, গান্ধী ছিল একটা অধ্যায়ের নাম, আর কিছু নয়। মানুষের স্মৃতি থেকে গান্ধী
ইতিমধ্যেই বিদায় নিয়েছেন। মানুষের মনে গান্ধীর যেটুকু স্মৃতি অবশিষ্ট আছে তা আছে কারণ
কংগ্রেস পার্টি প্রতি বছর গান্ধীর জন্মদিনে জাতীয় ছুটি দেয় আর এছাড়া তার জীবনের
বিভিন্ন দিনগুলি পালন করে। সপ্তাহকালব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণের
মধ্যে গান্ধীর স্মৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু এইসব কৃত্রিম মাতামাতি না
থাকলে, আমার মনে হয় গান্ধী অনেক অনেক আগেই জনগণের স্মৃতি থেকে বিদায় নিতেন।
বিবিসি – আপনি মনে করেন না উনি ভারতীয় রাজনীতিতে
কোনো মৌলিক পরিবর্তন এনেছিলেন...
আ: না না, আদৌ না। এমনকি আসলে উনি সবসময়ই দুরকম
কথা বলে গেছেন। উনি দুটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন – একটি ইংরাজি (দি হরিজন) আরেকটি
গুজরাটি। আপনি যদি ওনার প্রকাশিত দুটি পত্রিকাই পড়েন তাহলে আপনি দেখতে পাবেন
কিভাবে উনি মানুষকে ভুল বুঝিয়েছিলেন। ইংরাজি কাগজে উনি জাতপাত, অস্পৃশ্যতার
বিরোধী, গণতন্ত্রের পূজারী। কিন্তু গুজরাটি কাগজে উনি সেই চেনা ছকের কথা বলেন –
জাতপাত ও বর্ণাশ্রমের সমর্থক, সেই সমস্ত পুরনো গতানুগতিক ভাবনা যা ভারতবর্ষকে
পিছনে টেনে ধরে রেখেছে তার সমর্থক। কেউ যদি গান্ধীর জীবনী লিখতে চান তাহলে তিনি
যদি শুধু গান্ধীর ইংরাজি আর গুজরাটি লেখার একটা তুলনামূলক আলোচনা করেন তাহলেই একটা
বড় কাজ করা হবে। পাশ্চাত্যের সব পন্ডিতরা শুধু গান্ধীর ইংরাজি লেখাই পড়েন আর
ভারতের মানুষকে তাদের ভাষাতে গান্ধী কি বলেছিলেন সে খবর তাদের অজানাই থেকে
যায়।
বিবিসি – তাহলে ওনার আসল ইচ্ছা কি ছিল SC/ST বিষয়ে?
আ:- দেখুন বিগত ২০০০ বছর ধরে আমরা অস্পৃশ্যতার
বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। কেউ কোনোদিন এপ্রসঙ্গে কোনও কথা বলেনি। আমরা চাই
অস্পৃশ্যতার অবসান। কিন্তু শুধু অস্পৃশ্যতার অবসান সমস্যার সমাধান নয়। আমাদের দরকার সমান সুযোগ যাতে আমরা উঠে আসতে পারি বাকি জাতগুলির সমকক্ষ হতে
পারি। শুধুমাত্র ছোযাছুয়ির বেলাতেই নয়, আমাদের দরকার সুযোগ
যাতে আমরা বড় সরকারী চাকরি পেতে পারি সরকারের নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারি।
এবিষয়ে গান্ধী আমাদের পুরোপুরি বিরোধী ছিলেন। একেবারেই পুরোপুরি বিরোধী।
বিবিসি – উনি শুধু মন্দিরে প্রবেশ অধিকার নিয়েই
সন্তুষ্ট ছিলেন...
আ: একদম তাই। শুধু মন্দিরে প্রবেশ অধিকার। দেখুন
মন্দিরে প্রবেশ অধিকার নিয়ে অচ্ছুতদের খুব বেশি মাথাব্যথা নেই। আমি হিন্দু মন্দিরে
প্রবেশ অধিকার পেলাম অথচ আমার গ্রামে আমি পড়ে রইলাম বাইরে অস্পৃশ্য হিসাবে। একসময়
হিন্দুরা অচ্ছুতদের ট্রেনে চড়তে দিত না কিন্তু আজ সে অবস্থা নেই – তাতে কি খুব
বেশি কিছু যায় এসেছে কারো?
বিবিসি – আপনি বলতে চান উনি অচ্ছুতদের অবস্থার কোনও
মৌলিক পরিবর্তন চাননি...
আ: একদম ঠিক।
ওনার হরিজন আন্দোলন আসলে কেবলমাত্র হরিজনদের কংগ্রেসে নিয়ে আসার একটা
মামুলি ছক ছাড়া কিছুই না। এছাড়াও একটা ব্যাপার ছিল, উনি চেয়েছিলেন যেন কোনোভাবেই
হরিজন আন্দোলন ওনার স্বরাজের মুখোমুখি না দাঁড়ায়। উনি গ্যারিসন নন যিনি আমেরিকাতে
নিগ্রোদের অধিকারের প্রকৃত লড়াই লড়েছিলেন।
বিবিসি -
আপনি কি মনে করেন রাজনৈতিক স্বাধীনতা গান্ধী ছাড়াও আসত?
আ: অবশ্যই। স্বাধীনতা আসবারই ছিল। হয়তো তা হতো আর একটু ধীর
গতিতে এবং তাতে ভারতের আপামর জনগণের আরও ভালোই হতো! সেক্ষেত্রে বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া
জনগোষ্ঠীগুলি নিজেদের ঘর গুছানোর আরও খানিকটা সময় পেত। আজ (১৯৫৫ সালে - অনুবাদক)
দেখুন হঠাৎ করে পাওয়া স্বাধীনতা নিতে এই সমস্ত জনগোষ্ঠীগুলি আদৌ তৈরিই হতে পারেনি।
বিবিসি – আপনি কি মনে করেন গান্ধী কংগ্রেসের
রাজনৈতিক স্বার্থ দেখেছিলেন স্বাধীনতার সময় নির্বাচনের ক্ষেত্রে?
আ: - দেখুন এটা আমি জানিনা। তবে এটুকু বলতে পারি
যে আমি জানিনা মি অ্যাটলে (Clement
Richard Attlee সে সময় ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, লেবার
পার্টি – অনুবাদক) হঠাৎ কি করে রাজি হয়ে গেলেন স্বাধীনতা দিতে। এটা একটা সিক্রেট।
আশা করি ভবিষ্যতে কোনো একদিন মি: অ্যাটলে নিশ্চয়ই সে রহস্য উন্মোচন করবেন তার আত্মজীবনীতে। কেউ এটা আশা করেনি,
হঠাৎ করে কি ঘটনা ঘটল যাতে এমন তাড়াহুড়োর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা করতে হলো।
আমার ব্যক্তিগত মতামত যদি বলেন তাহলে বলতে পারি দুটি বিষয় এক্ষেত্রে কাজ করেছিল।
প্রথমত, ব্রিটিশ শাসন নিশ্চিন্ত ছিল যে ব্রিটিশ রাজের প্রতি সেনাবাহিনীর আনুগত্য
অটুট থাকবে। সে ধারনাটা একটা বড় ধাক্কা খায় সুভাষ চন্দ্র বোসের কাছে। সেনাবাহিনীর
মধ্য বিদ্রোহ এক বাস্তব সম্ভাবনা হয়ে উঠছিল। এক্ষেত্রে ভারতে শাসন চালাতে গেলে
ব্রিটিশকে অনেক অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হতো ইউরোপিয়ান সেনা পুষতে। অর্থাৎ সেই
১৮৫৭র সিপাহী বিদ্রোহের পরিস্থিতি। আর তাছাড়া ভারতবর্ষের বিশালতা মনে করলে, এত বড়
দেশকে ব্রিটিশ সেনা দিয়ে দমন করতে গেলে যত সেনা লাগত তা ইংল্যান্ডের পক্ষে যোগানোও
সম্ভব ছিল না। এছাড়া যে বিষয়টা শাসকের মধ্যে কাজ করেছিল তা হলো তার ব্যবসা এবং
পুঁজির স্বার্থ সুরক্ষিত করা। যদি ভারত রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীন হয়েও যায় কিন্তু
ব্রিটিশ পুঁজি ভারতীয় শাসকদের হাতে সুরক্ষিত থাকে তাহলে অসুবিধা কোথায়? বরং সেটা
মেনে নিয়ে সেরকমভাবে পরিকল্পনা করাটাই বাস্তবোচিত এবং বুদ্ধিদীপ্ত!
বিবিসি – পুনা চুক্তির সময় আপনার এবং গান্ধীর
মধ্যে কি কথা হয়েছিল সে বিষয়ে যদি কিছু বলেন। (২৪শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩২
সালে পুনের ইয়েওয়াড়া জেলে গান্ধী এবং আম্বেদকরের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়।
এর বিষয় ছিল স্বাধীনতাত্তোর ভারতের সংবিধানের পরিকল্পনা এবং সেখানে বিভিন্ন জাতি
গোষ্ঠীগুলির আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব। এবিষয়ে আম্বেদকারের সাথে গান্ধীর চরম বিরোধ হয়
কারণ গান্ধী অচ্ছুতদের আলাদা প্রতিনিধিত্ব স্বীকার করতে চাননি। পরে অবশ্য তাকে
আম্বেদকারের যুক্তির সামনে হার মানতে হয়। এই মর্মে স্বাক্ষরিত চুক্তি ইতিহাসে পুনা
চুক্তি নামে বিখ্যাত)
আ:- ম্যাকডোনাল্ডের (Ramsay MacDonald, ১৯৩২ এ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) প্রাথমিক খসড়ায় উনি আমার প্রস্তাব মেনে
নেন। আমি বলেছিলাম দেখুন হিন্দুরা
অচ্ছুৎদের আলাদা প্রতিনিধিত্ব চায় না কেননা তা নাকি জাতীয় সংহতির পরিপন্থী। কিন্তু আমরা, দলিতরা মনে করি যে যদি আমাদের আলাদা
প্রতিনিধিত্বের অধিকার না থাকে, তবে আমরা উঁচু জাতের নীচে চাপা পড়ে যাব। আর পিছড়ে
বর্গের প্রতিনিধি হিসাবে যে থাকবে সে পরিণত হবে উঁচু জাতের বাবুদের চাকরে। আমাদের
আলাদা প্রতিনিধিত্বের অধিকার পেতেই হবে। আমি আরো বলেছিলাম আমাদের দুটো ভোট থাকুক –
একটা নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার আর একটা সাধারণ নির্বাচনের ভোটাধিকার
সেক্ষেত্রে আর জাতীয় সংহতির কোনো সমস্যা থাকছে না। আমি বলেছিলাম সারা জীবন দলিতদের
হিন্দুদের থেকে আলাদা হয়ে থাকতে হয়, কোনো রকম সামাজিক বা ধর্মীয় মিশ্রণের প্রশ্নই
নেই হঠাৎ পাঁচ বছরে এক দিনের ভোট যজ্ঞে এক হিন্দুদের সাথে একসাথে ভোট উৎসবে
যোগদানের মধ্য দিয়েই কি জাতীয় সংহতির বিকাশ ঘটে যাওয়া সম্ভব? এ হতে পারে? এটা কি
বোকার মতো চিন্তা নয় যে দুটো লোক এক সাথে একই বুথে ভোট দেওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের
হৃদয় পরিবর্তন হয়ে যাবে? একারণেই আমি ওনাকে (ম্যাকডোনাল্ডকে) বলেছিলাম আমাদের দুটো
ভোট দিন। Communal Award ও আমার প্রস্তাব ছিল যা ম্যাকডোনাল্ড গ্রহণ
করেন। কিন্তু গান্ধী কখনোই চাননি আমরা দলিতরা আমাদের নিজেদের প্রতিনিধিত্বের
অধিকার পাই। সুতরাং উনি অনশন শুরু করে দিলেন। কিন্তু ম্যাকডোনাল্ড বললেন Communal Award জাতীয় সংহতির পরিপন্থী নয় বরং বিভিন্ন
জাতিগুলিকে কাছে আনার চেষ্টা আর তাই সরকার একে প্রত্যাহার করবে না। কিন্তু গান্ধী
অটল। উনি বললেন ভারতে আমি শুধু তিনটি জাতিকে স্বীকৃতি দিতে পারি – হিন্দু, মুসলিম
এবং শিখ। রাষ্ট্র কেবলমাত্র এই তিনটি জাতিকেই স্বীকার করবে তার সংবিধানে। খ্রিস্টান,
অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বা দলিত জাতিগুলিকে সংবিধান স্বীকার করবে না। তাদেরকে মিশে যেতে
হবে অন্য জাতির মধ্যে। এরকম অদ্ভুত কথা এমনকি তার বন্ধুরাও সমর্থন করতে পারেননি।
তারাই প্রশ্ন তুললেন – আচ্ছা আপনি যদি মুসলমান এবং শিখদের আলাদা স্বীকৃতি দিতে
সম্মত হন যারা দলিতদের থেকে অন্তত ১০০০ গুন বেশি শক্তিশালী রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে,
তাহলে দলিতদের আপনি ভুলে যান কি করে? এ প্রশ্নের তার একটাই জবাব ছিল – তোমরা
আমাদের সমস্যা বুঝবে না – ব্যাস এইটুকুই। মি আলেকজান্ডার এবং তার অনুগামী এক ফরাসী মহিলা, নামটা
স্মরণে আসছেনা এখুনি, গান্ধীর সাথে এক বড় বিবাদে জড়িয়ে পড়েন এবিষয়ে। তারা বলেন, দেখুন
আপনি যদি বলেন কোনো জাতি বর্ণ বা ধর্মের কোনো উল্লেখ বা স্বীকৃতি সংবিধানে থাকবে
না তাহলে সে কথার একটা মানে হয় এবং সেটা গণতান্ত্রিক। কিন্তু আপনি যদি বলেন শুধু
বেছে বেছে হিন্দু, মুসলমান আর শিখদের স্বীকৃতি থাকবে তবে তার কোনো মানে হয় না।
গান্ধী কোনো উত্তর দিতে পারেননি। গান্ধী আদৌ দলিতদের প্রতিনিধিত্ব স্বীকার করতেই
প্রস্তুত ছিলেন না। তার নিজের উপদেষ্টামন্ডলীই তখন তাকে বলেন যে এতটা গোঁড়ামি কেউই
সমর্থন করবে না। সে সময় মি মালব্য (মদন মোহন মালব্য – অনুবাদক) আমার কাছে আসেন
একটা আপোষ রফার জন্য। আমি ওনাকে বলি দেখুন আমি ব্রিটিশের সাথে লড়াই করে দলিতদের যে
অধিকার আদায় করেছি তা গান্ধীর সাথে রফার স্বার্থে জলাঞ্জলি দিতে পারবো না। যাইহোক
একটা আপোষ রফার সূত্র আমি প্রস্তাব করি। দলিতরা তাদের তরফ থেকে চার জন প্রতিনিধিকে
আগে নির্বাচন করবে যারা সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। এবং স্বাভাবিকভাবেই এদের
মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় যে সেই শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত হবে। এর মধ্য দিয়ে অন্তত এটুকু
করা যাবে যে উঁচু জাতের লোকেরা দলিতদের প্রতিনিধিকে তাদের ইচ্ছামত নির্বাচন করতে
পারবে না। এই প্রস্তাব আর গান্ধীর পক্ষে খারিজ করা সম্ভব হয়নি। এই ফর্মুলায় একটিই
মাত্র নির্বাচন হয়েছিল ১৯৩৭ সালে এবং সেখানে গান্ধীর মনোনীত একজন প্রার্থীও জয়ের
মুখ দেখেননি।
বিবিসি – গান্ধী কি এবিষয়ে দর কষাকষি করেছিলেন?
আ: - ভয়ঙ্কর রকম! আমি ওনাকে বলেছিলাম দেখুন আমি
আপনার জীবন এবং সম্মান বাঁচাতে চাই কিন্তু তা আমার দলিত ভাইদের বলি দিয়ে নয়। আপনি
বলুন শুধুমাত্র পাঁচ বছরে একদিন একটা সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়ে কিভাবে মানুষের
জীবনের তার সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন হতে পারে?
বিবিসি – এর জবাবে উনি কি বলেছিলেন?
আ:- উনি কিছুই বলতে পারেননি। উনি ভয় পেয়েছিলেন
যে একদিন দলিতরা সমান শক্তিশালী হয়ে উঠবে শিখ এবং মুসলিমদের মতো এবং হিন্দুরা একা
হয়ে যাবে, কোণঠাসা হয়ে যাবে যখন দলিত, মুসলিম, শিখ এবং অন্যান্য পিছিয়ে পড়া
জাতিগুলি মাথা তুলে দাঁড়াবে।
বিবিসি – এবিষয়ে উনি একজন সাধারণ রাজনৈতিক নেতার
মতই আচরণ করেছিলেন মহাত্মা হিসাবে নয়।
আ: - একদমই তাই। উনি একজন হিন্দু রাজনৈতিক নেতা
ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না। আমি কোনোদিন ওনাকে মহাত্মা বলে সম্বোধন করিনি, আমি মনে
করি না উনি মহাত্মা ছিলেন। এমনকি নৈতিকতার বিচারেও আমি ওনাকে মহাত্মা বলতে পারবো
না।
No comments:
Post a Comment