Friday, August 29, 2014

মহর্ষি কারুয়াকের স্বপ্নাদেশ এবং আমার কৈফিয়ত

সরস্বতীকে কিস করে পরীক্ষা দিতে যাবি? মেয়েদের কমন রুমের এক কোনায় রয়েছে এবারের কলেজের সরস্বতীর মূর্তিটা। অস্বীকার করা যাবে না গোটা মূর্তিটার একটা বেশ জোরালো সেক্স অ্যাপিল আছে। শুভ মিত্র, আমার প্রিয় বাল্যবন্ধু, খগেন্দ্রনাথ মিত্রের নাতি, একটু ঘাড় কাত করে বিড়িতে একটা টান দিয়ে বলল “না এটা চাপ হয়ে যাবে”। ডুয়েলে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে নায়িকার কাছে বিজয়ীর ভাব নিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম সরস্বতীর দিকে। একটা প্যাশনেট কিস ...

পরদিন ছিল ইলেভেন থেকে টুয়েলভে ওঠার পরীক্ষা। বলা বাহুল্য সরস্বতীর অভিশাপেই আমি অত্যন্ত অনায়াসেই এবং যথেষ্ট ভালো নম্বর পেয়েই ইলেভেন থেকে টুয়েলভে উঠেছিলাম।
সরস্বতীর রূপ বর্ণনা পড়ি বা অনুভব করি সেই সময়ের প্রায় পঁচিশ বছর পর। সরস্বতী শুভ্রবসনা। তাঁর একহাতে বীণা আর অপর হাতে পুস্তক, চারটি বেদ এবং জপমালা। বারোয়ারি সরস্বতীর দৌলতে বীণাটা ঠিক আছে কিন্তু বইগুলো চলে গেছে পায়ের কাছে আর হাতটা একটা আশীর্বাদের প্রেসক্রিপশন মার্কা পোজের আকার পেয়েছে। এর মধ্যে জড়ানো থাকে একটা চাঁদমালা – কস্ট এফেক্টিভ এবং হেডেক অ্যাভয়েডিং জপমালার সাবস্টিটিউট। আর এন গুহ রোডের যে শিল্পী এটি বানিয়েছেন তাকে হয়তো গতবারের লক্ষ্মী পূজায় বিক্রি না হওয়া একটা মূর্তিকে সরস্বতী বানাতে হবে অতএব ... সবার উপর মার্কেট সত্য তাহার উপর নাই। অত পিতপিতানি থাকলে যা না নিজে পয়সা দিয়ে অর্ডার দিয়ে ডাইস বানিয়ে মূর্তি বানা গিয়ে যা ... দেখলে হবে? খরচা আছে।

ভালো কথা এসব কথা এ-লেখায় কেন? আসলে আমি বলতে চাই এ-লেখাটা কারুয়াক নিয়ে বয়ান – একটি লিটল ম্যাগাজিনের সংখ্যা বের করার ভাবনা – এই ভাবনাটাকে নিয়ে। তাই এই প্রসঙ্গে সরস্বতীর প্রসঙ্গ।
বেদ অর্থে চতুর্বেদ নয় – বেদ অর্থে জ্ঞান যে জ্ঞান আছে পুস্তকে আছে বহির্বিশ্বে আর জপমালা অর্থে সাধনা – একান্ত অন্তরঙ্গ একাকী নিঃসঙ্গ অন্তরতম বিশ্বের On the Road জার্নি। “On the Road” বেদ, জপমালাটা কই?

জপমালা-হীন বেদের চর্চা একরকম কঠিন প্রজাতির জন্ম দেয়। এদের মধ্যে আমি নিজেও পড়ি এমনকি নিজেকে এই শ্রেণীর একজন অগ্রণী সৈনিক (আসলে মনে মনে ইচ্ছা সেনাপতি হবার কিন্তু চাপ নিতে পারবোনা) বলেই মনে করি। আমাদের রাশি হল গিয়ে খচ্চর আর রাশির অধিপতি হলেন গিয়ে বল্লাল সেন। বাঙলায় শ্রীবল্লাল সেনেরই ইচ্ছায় বা লীলায় গাধা আর ঘোড়ার মিশ্রণে জন্ম হয় আমাদের আদিমতম পুরুষের। আমাদের উল্লেখ পাওয়া যায় গীতায় কর্মযোগে যেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন “যদি আমি কর্ম না করি তাহা হইলে এই লোকসকল উৎসন্ন হইয়া যাইবে। আমি বর্ণ-সঙ্করাদি সামাজিক বিশৃঙ্খলার হেতু হইব এবং ধর্মলোপ-হেতু প্রজা-গনের বিনাশের কারণ হইব”। অর্থাৎ ঠিক দশাবতারের মধ্যে না পড়লেও আমাদের আদিতম পুরুষ খচ্চর এক অর্থে বিষ্ণু বা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের-ই এক অবতার। কলিযুগের সূচনা হিসাবে ধরা হয় মহাভারতের যুদ্ধের অবসানকে। কলিযুগের বৈশিষ্ট্য হিসাবে উল্লিখিত আছে বর্ণ-সঙ্করের আধিপত্যের। কলিযুগে বর্ণ-সঙ্কররাই শাসন করবে। আমার একান্ত ব্যক্তিগত একটা সন্দেহ আছে এই বিষ্ণুর কল্কি অবতার নিয়ে। মানে যদি কলি যুগের শেষে ধ্বংস অনিবার্য হয় তবে কল্কি অবতারের তো কাজ হবে সেই অনিবার্যতাকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলার – তার মানে কি কল্কি অবতার আসলে একটা খচ্চর?

টিনের তলোয়ারে গুরুদেব কাপ্তান-বাবু চীৎকার করে বলে গিয়েছেন “হা হা হর-বাবু ইংরাজিটা যে আমি একেবারে বুঝি না তা নয় .. হাঙ্গরি মানে যে হাঙ্গরের মত ক্ষুধার্ত তা আমি জানি”। অতএব কোনও কথা হবে না। খিদে পাবে না? শেষ কবে খেয়েছিলাম শালা মনে নেই, লাস্ট সংখ্যায় লেখা ছাপা হলে একটা বাঙলার বোতলের গল্প হওয়ার কথা ছিল, সেটার তো কোনও উচ্চবাচ্য দেখছি না তবে খিদেটা আমার লাগবে নাতো কি আপনার পিতৃদেবের লাগবে?

খিদে সর্বস্ব চিন্তা ভাবনা নিয়ে দৌড়ে বেরিয়েছি এতগুলো বছর – এখনো দৌড়ে যাচ্ছি। এই খিদেরই বহিঃপ্রকাশ কারুয়াক আর তারও পরে কারুয়াক নিয়ে লিটল ম্যাগাজিনের সংখ্যা করার ভাবনা। খিদেটা আরও ব্যাপ্ত হয় রাজনৈতিক পরিসরে – দল পাকানোটা ভালো জমে – দুনিয়ার ক্ষুধার্ত এক হও স্লোগানে ভরে যায় আকাশ।

“On the Road” ঠিক কতজন পড়েছে বা আপ্লুত হয়েছে সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু একথা প্রায় নিঃসন্দেহে বলা চলে যে এই পত্রিকা এবং এই লেখা যারা পড়ছেন তারা, মানে আমরা সকলে একমত যে ওটা বেদ। যেমন ঋগ্বেদের উদাহরণ হিসাবে নিঃসন্দেহে বলা যায় মহর্ষি কার্ল মার্ক্স বিরচিত ক্যাপিটাল। আমরা আম জনতারা হয়তো ক্যাপিটাল পড়িনি কিন্তু ওটা যে বেদ সে নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই।  আমাদের শ্রেণীগত বা রাশিগত বৈশিষ্ট এই যে আমরা আর বেদ পড়ার চাপ নিই না কিন্তু ওটা সম্বন্ধে ঠেকে কিংবা কফি হাউসে বা ফেসবুকে কমেন্ট করার মতো যথেষ্ঠ মশলা মজুত করে নিই – অন্যদের সাথে আড্ডা মেরে বা উইকিপিডিয়া, লিটল ম্যাগাজিন এবং আনন্দবাজার পড়ে। সব মিলিয়ে একটা বৌদি থুরি বেদ ভিত্তিক সাম্যবাদের স্বপ্নে কেটে গেছে আমাদের বা বিশেষভাবে আমার শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের অনেককটা বসন্ত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে বৌদি থুরি বেদের গুরুত্ব নিয়ে আমাদের কারও কোনওরকম সন্দেহ ছিল না বা নেই। আর তাই কারুয়াক নিয়ে বয়ানের সংখ্যা সেই মহর্ষি বেদ রচয়িতার প্রতি এক গুরুদক্ষিণা মাত্র।বয়ানের আগের সংখ্যায় লেখাটায় অনেকটা চলে গিয়েছিল আমার লেখা কি সেটার ব্যাখ্যান করতে। এবারে আর সেসব চাপ নেব না এক কথায় শুধু এটুকু বলতে পারি – এগুলো আমার কথা – ব্যক্তিগত অনুভবমাত্র এর আর কোনোরকম গুরুত্ব বা শ্রেণীবিভাগ নেই। এই লেখার প্রেরণা স্বতস্ফূর্ত অনুভব যে অনুভব এসেছে আমার জার্নি আমার জীবনের “On the Road” থেকে। আর সাথে যুক্ত হয়েছে মহর্ষি কারুয়াকের স্বপ্নাদেশ – “তুই On the Road – এর জপমালাটা নিয়ে লেখ।”

আমি বিশ্বাস করি প্রত্যেক সরস্বতীর সাধকেরই জপমালাটা থাকে কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশ হয় না বেশিরভাগ সময়ই। জপমালাটার কোনও মার্কেটেবল প্রোডাক্ট তৈরীতো হয়ই না উল্টো সেটা মার্কেট ইকনমিকেই চ্যালেজ্ঞ জানিয়ে বসে থাকে। কিন্তু তাও বর্হিবিশ্বের আর অর্ন্তবিশ্বের উভয়ের ই ভ্রমণ শেষে পৌছান যায় সেই একই সত্যে – যত মত তত পথ। আমার নিজের অনুভবের থেকে একটা উদাহরণ দিয়ে ভাবনাটা বোঝাবার চেষ্টা করছি।

“সৃষ্টির প্রারম্ভে পরমেশ্বরের স্বাতন্ত্রশক্তি, বহু হওয়ায় খেলিতে থাকে। যতক্ষণ বহুভাবের সম্যক্ বিকাশ না হয় ততক্ষণ এই ইচ্ছা কার্য করিতে থাকে। ইহা কালের ঈক্ষণরূপে বীজভাব প্রাপ্ত হইয়া মহামায়ার গর্ভে সুপ্ত থাকে। ইহাই সুপ্ত জীবসমষ্টি”। এই বিরাট সৃষ্টি, এ জগৎ আমি, আপনি এবই আসলে ঈশ্বরের এক থেকে বহু হবার ইচ্ছে অনুসারে ছুটে চলেছে। এই ছুটে চলার সমান্তরালে, এর বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সময় – সময় এর নির্ণায়ক। সময় একমুখী গতি নিয়ে নির্ধারণ করছে প্রতিটি জীবের প্রতিটি বহূত্বের বা বলা ভালো প্রতিটি বহুত্বের স্বতন্ত্র আমিত্বের। শিব-শক্তির যে রূপ আমরা সাধারণত দেখে থাকি অর্থাৎ মাকালীর মূর্তির রহস্য বা বলা ভালো গল্প থেকে এটা আরো ভালো বোঝা যাবে। মা-এর এই রূপটি নিত্য প্রলয়ের রূপ। নিত্য প্রলয় অর্থাৎ জীবের সাধারণ জীবনচক্রের আবর্তনে জীবিত হওয়া ও স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করার প্রক্রিয়া। এই কারনেই মা এর অধিষ্ঠান শ্মশানে। এক হাতে খাঁড়া, অন্যহাতে কাটা মুন্ডু আর বাকি দুই হাতে দুটি মুদ্রা – বরাভয় ভয়কে জয় করার সাহস আর আশীর্ব্বাদ। এই মূর্তি প্রতীক এই বিরাট গল্পের বা একরকম উপমা একটা ভাবনার বা অত্যন্ত জটিল একটি কনসেপ্টের। এই কালীর গুরু হচ্ছেন সময় বা শনিদেব। কাল অর্থাৎ সময়ের সাথে ই অর্থাৎ ইচ্ছা বা মায়া যা পরমেশ্বর মানে শিবেরই এক প্রকাশ যোগ হয়ে হয় কালী। অর্থাৎ নিত্যপ্রলয়ের সৃষ্টি এবং লয় উভয়ই সময়ের উপর নির্ভরশীল এবং তা ঘটে চলেছে সময়ের একটি নির্দিষ্ট দিকে। এই দিকটি হলো পরমেশ্বরের বহু হওয়ার আকাঙ্খার দিক।

“The Theory of Everything” বইতে স্টিফেন হকিং বলছেন – “মনে করুন একটা টেবিলের উপর একটা কাপ রাখা আছে। কাপটা মাটিতে পড়ে কয়েকটুকরো হয়ে ভেঙ্গে গেল। আমি এই ঘটনাটা একটা ভিডিয়ো ক্যামেরাতে রেকর্ড করে নিলাম আর তারপর সেটা উল্টো করে চালিয়ে আপনাকে দেখালাম যাতে দেখা গেল কতগুলো ভাঙা কাপের টুকরো নিজে থেকে জোড়া লেগে গিয়ে একটা আস্ত কাপ হয়ে গিয়ে মেঝে থেকে টেবিলের উপর ফিটফাট হয়ে উঠে বসল। আপনিতো ধরে ফেলবেন যে সময়টাকে উল্টো দিক দিয়ে দেখানো হয়েছে অর্থাৎ সময়ের অভিমুখ সম্বন্ধে মানুষের একটা সহজাত ধারণা আছে। এটাকেই বলা যাক Psychological arrow of Time.  আবার মজার কথা এইযে এই অভিমুথটা মিলে যাচ্ছে Thermodynamic arrow of Time এর সাথে। কেন আমরা ভাঙা কাপকে জোড়া হয়ে উঠে পড়তে দেখিনা তার কারণ ওটা মার্ফিসাহেব থার্মোডায়নামিক্সের দ্বিতীয় সূত্রে নিষেধ করে গেছেন। মার্ফিসাহেব পই পই করে বলে গেছেন Things get worse. An intact cup on the table is a state of high order, but a broken cup on the floor is a disordered state. One can therefore go from the whole cup on the table in the past to the broken cup on the floor in the future, but not the other way around.”। অর্থাৎ এনট্রপির বা অস্থিরতার তথা বহুত্বের বিকাশের দিকেই সময়ের অভিমুখ – এমনটা মনও বলছে, মহর্ষি মার্ফিসাহেব তার থার্মোডায়নামিক্সের দ্বিতীয় সূত্র নামক বেদেও বলে গেছেন।


 তাহলে অর্ন্তবিশ্বের অভিমুখের এই যাত্রা, এই জার্নিকে অস্বীকার করি কি করে? বহির্বিশ্ব সৃষ্টি রহস্য আর অর্ন্তবিশ্বের রহস্য কি একই চৈতণ্যের আভাসমাত্র? এপ্রশ্নর মীমাংসা নাহোক অন্তত একটা আলোচনা পর্যন্ত হবে না? আলোচনা হবে না “তন্ত্রাভিলাষীর সাধুসঙ্গ” বা “তপোভূমি নর্মদা” নিয়ে? বা “কথামৃত” নিয়ে? না হবে না। কেন? – হবে না কারন আমরা খচ্চর রাশির জাতক।
জপমালাহীন বেদের সাধনা করলে আলটিমেটলি ইয়ে মারা যায় আর কি। কি হতে পারে সেটা বক্রেশ্বরের অঘোরী বাবার সাথে প্রমোদ কুমার চট্টোপাধ্যায়ের কথোপকথন “তন্ত্রাভিলাষীর সাধুসঙ্গ” থেকে তুলে দিলাম।
“ আমি বললামঃ অবশ্য অত্যন্ত জড়বুদ্ধি মূর্খ প্রকৃতির-
বাধা দিয়া, তিনি চীৎকার করিয়া বলিলেন : ওরে শালা বোকারাম, তুই যে আকাশ থেকে পড়লি। - তুই পাগলামী করিস নে। তোদের ওই সভ্য ভদ্দোর ইজ্ঞিরি পড়া, এডুকেটেড বিদ্বান বুদ্ধিমান সমাজের মানুষই বেশী বেশী এই দলের। যারা যথার্থ অসভ্য মূর্খ, খেটে খুটে খায়, তারা অনেক সংযতভাবে ইন্দ্রিয় ভোগ করে, তারা এখনও প্রকৃতির বশে অনেকখানি চলে, প্রকৃতির সাথে তাদের সম্বন্ধ বেশী ঘনিষ্ঠ এটা কি তোরা জানিস না, অথচ সহরে থাকিস্। আচ্ছা বল্ দেখি, পুরুষত্বহীনতা, অজীর্ণ, হৃদরোগ, স্নায়ুরোগ, পক্ষাঘাত, বাত, মূত্ররোগ, যক্ষ্মা – এসব রোগ ভদ্দোর লোকের মধ্যে বেশী না ছোটোলোকের মধ্যে বেশী?
- সেটা সত্য, - ঐ সব রোগ ভদ্দোর লোকের মধ্যেই বেশী, তা খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন থেকে বুঝা যায়।
- তুই এটা বুঝিস না, বিদ্যা-বুদ্ধির সাথে বেশী পরিচয় না হলে, বেশী সভ্য না হলে, ইন্দ্রিয়-সুখের এত ব্যাভিচার আসবে কোথা থেকে?  সরলবুদ্ধি অসভ্য মূর্খেরা ওসব অবৈধ ইন্দ্রিয়-চালনার প্রবৃত্তি, সাহস পাবে কোথা থেকে? এই শালা তুই শয়তানের পরিচয় জানিস নি, সে যে বিদ্যাবুদ্ধিতে ভগবানের দোসর, সেকি মুখ্যু অসভ্যের দল নিয়ে ব্যবসা করে?”          
এখানে “ইন্দ্রিয়-চালনার প্রবৃত্তি” টাকে একটু বলতে ইচ্ছে করছে মানে আমি এর যেটা বাঙলা মানে করেছি সেটা একটু শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে।
“ইন্দ্রিয়-চালনার প্রবৃত্তি” অর্থাৎ প্যাট এবং চ্যাট। প্যাট অর্থাৎ হজম হোক বা না হোক, যা আমি খেতে পারি বা ভোগ করতে পারি সেটা আর্সেনলের বিরিয়ানি হতে পারে, স্যামসুঙ গ্যালাক্সি ইয়ে মডেলটা হতে পারে, ভ্যাট সিক্সটিনাইন বা বাঙলা হতে পারে বা বকেয়া ৪৭% (মতান্তরে ৬৮%) ডি এ হতে পারে বা আরো যা কিছুই হতে পারে। একটা আস্ত শপিং মলে যা যা আছে তার সবই আমারই প্যাটের নিমিত্ত বলিপ্রদত্ত। এর সবটাই আমি চাই।
চ্যাট বলতে প্যাটের থেকে কয়েক আঙুল নীচের সেই সেই সেই অংশটির কথা বলা হচ্ছে – বাকি ব্যাখ্যান নিষ্প্রোয়জন।
খচ্চর রাশির কাছে এসবের সলিউশন আছে। কেমন? কেন উদাহরণ দিলাম না? জপমালার কস্ট এফেক্টিভ সলিউশন – চাঁদমালা, আর একান্তই যদি আটকে যায় তাহলে দুই রকম সর্বরোগহর দাওয়াই আছে।

দাওয়াই নাম্বার এক : প্রলেতারিয়েতের নেতৃত্বে একটি সঠিক কমিউনিস্ট পার্টি গঠন না করতে পারলে এইসব কন্ট্রাডিকশনগুলিকে ধারণ করবার কোনও আধার পাওয়া যাবেনা। সুতরাং এর উত্তর পেতে গেলে পার্টি গঠনের সংগ্রামকে তরান্বিত করতে হবে। অতএব আজ, এখন বা কাল সকালে কি করিতে হইবে জানা যায় না কারণ লেনিন উহা বলিয়া যাইতে ভুলিয়া গিয়াছেন।
দাওয়াই নাম্বার এক (ক): আরে, আসলে আমরাই সেই সর্বরোগহর মহান কমিউনিস্ট পার্টি এই সোজা কথাটা বাকিরা বুঝতে পারছেনা। রোসো, বসো এসো পার্টি অফিসে চা ফা হবে, আড্ডা হবে আর সিজন থাকলে দু একটা আন্দোলন টান্দোলন ও করা যাবে – মিডিয়ায় তোমার এক শালা আছে বলছিলে না? তবে দেখো বাবা অফ সিজনে যেমন পূজোর সময় টময়ে আন্দোলন টান্দোলন করতে চাইলে কিন্তু পড়তায় পোষাবে না। শীতকালে দুপুর বেলাটা বেশ ভালো আর শনি রবিবার ডেট করলে কিন্তু অনেককে পাবেনা। হ্যাঁ প্রেসি বা যাদবপুরে দু-একটা সেমিনার করতে পারো তো আর তোমরা ওইসব ফেসবুক টেসবুক কিসব বলো ওতে দিয়ে একটু ক্যাম্পেন ট্যাম্পেন করে দিতে পারলে বেশ ভালো ছেলেপুলে পেয়ে যেতে পারো। এইসব টাইমপাস চলতে থাকুক তারপর দেখো না যাবে কোথায়? সব শালাকে এই ঘাটেই আসতে হবে। টাইমপাস দীর্ঘজীবী হোক।
দাওয়াই নাম্বার এক (খ) : আসলে মার্ক্সকে এক্সটেন্ড করার যে কাজটা লেনিন আর তারপর মাও করেছিলেন সেটা আর মাওএর পর এগোয়নি। সাম্রাজ্যবাদের এই চেহারার কংক্রীট অ্যানালিসিসটা কোনো শালা করেনি – কেউ না, সব শালা খালি বাতেলা মেরে বেরিয়েছে। আমরা এই কাজটা শুরু করেছি – কাগজটা পড়ছো তো? এসো কফি হাউসে আমরা রোজই প্রায় বসি আর কাজটা এগিয়ে নিয়ে যাই। এমুহুর্তে এছাড়া আমরা আর কিই বা করতে পারি?      
কি এক নম্বরের দাওয়াই পছন্দ হচ্ছে না? নানা শুধু এক-এর খ পর্যন্ত নয় এর এত ফ্লেভার আছে তাতে চাইনিজ বর্ণমালা ফুরিয়ে যাবে। ফ্লেভারটা পরে দেখছি – বেসিক ড্রাগটা পছন্দ করুন।
কি এতগুলো ফ্লেভার তাও কোনোটা পছন্দ হলো না? ওকে কুছ পরোয়া নেই – আপনি এদিকে চলে আসুন – আপনার জন্য অন্য দাওয়াই আছে। এতে খরচা একটু বেশী পড়ে কিন্তু সিওর শট। একেবারে প্যাকেজ ডীল – গ্রাম্য প্রকৃতি, বেড়ানো, বাউল গান, অফুরন্ত মদ এবং গাঁজা এবং একটু সাহসী হতে পারলে আর পকেটের জোর থাকলে মেয়েটাও হয়ে যাবে। কেউ ধরবে না তবু বলা যায় না চুলকানি করার জন্য কোনো শালা যদি সাধনা টাধনার কথা বলতে আসে তবে তো আপনার কাছে মোক্ষম দুটো ব্রম্ভাস্ত্র রয়েছে – এক গুরু কই? আমাদের মতো ঢ্যামনাদের কি গুরু অত সহজে মেলে? আর বাই চান্স একটা গুরু ধর পেয়েই গেলাম, সাধনসঙ্গী বা সাধনসঙ্গীনী কই? এতো বাবা যুগল সাধনা কোনো কথা হবে না ... বল্ বল্ না কি বলবি বল? দেখবেন থোতা মুখ একেবারে ভোঁতা হয়ে গেছে।

আমার কৈফিয়ত
মহর্ষি কারুয়াক আমাকে ক্ষমা করুন। আপনার স্বপ্নাদেশ সত্ত্বেও “On the Road” এর জপমালা নিয়ে লেখার সাহস, ধৈর্য্য, অধ্যাবসায় কোনোটাই আমি অর্জন কর উঠতে পারলাম না। আমি নিতান্তই একটা গিনিপিগ। আমাকে চালনা করে নক্ষত্র, আমার ভেতরের অন্ধকার, মিডিয়া, প্যাট এবং চ্যাটের ভাবনা, আর্থ সামাজিক কাঠামো, রাষ্ট্র আরো কারা কারা সব। একটু ভেবে দেখলেই দেখবেন আমার এতে কোনও দোষ নেই। আমি এক গিনিপিগ যে কতগুলো অনিবার্যতার সমাপতনের এক করুণ বা আরো ভালোভাবে বলা যায় প্যাথেটিক রেজাল্ট মাত্র।
আমি রাজারাপ্পা – মা ছিন্নমস্তার মন্দিরের আমার নিজের যাত্রার জপমালাটাই এখনো পর্যন্ত খুঁজে পেলাম না। আসলে ছোটোবেলা থেকে শিখেছি বেদ বুঝতে অসুবিধা হলে সলিউশন আছে পর্যায়ক্রমে ডিকশনারী, গুগল, উইকি এবং অবশেষে প্রফেসর। কিন্তু জপমালাতে প্রথম পাটা ই কোনোদিন ফেলিনি তা বুঝবোটা কি করে? আটকে গেছি। তবে এটা বুঝতে পারছি যে কোন কোনটা বাদ যাবে একেবারে প্রথমেই – যেমন ভ্রমণ বৃত্তান্ত – কিভাবে কোন গাড়িতে কিভাবে যাওয়া হলো, কার কার সাথে দেখা হলো, তারা কে কি বললো, এলাকার আর্থ-সামাজিক ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় পটভূমি এবং তার বিশ্লেষন ইত্যাদি। তাহলে হাতে কি থাকলো? মন্দির, ধর্ম? অর্থা৭ ক্ষমতার বাতিস্তম্ভ? – হতে পারে না তবে এও বাদ দিতে হবে। কি সেই ছিন্নমস্তার গুহ্য রহস্য যা প্রকাশ হলে রুদ্রগ্রন্থির বন্ধন ছিন্ন হয়?  কি তার মূর্তি? রাজারাপ্পার ছিন্নমস্তার মূর্তি সম্পর্কে একটা দীর্ঘ আলোচনা করা যেতে পারে কিন্তু সে কথা এখানে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। মোটমাট এই মূর্তির যাদু আছে কিন্তু আমার মনে হয়েছে এটা নয় আরো কিছু আছে। বিভিন্ন লেখায় ছিন্নমস্তার যে ছবি আমি পেয়েছি সেই রূপ আমার ধারণা এবং জ্ঞানের চৌহদ্দিতে কোথাও আছে বা কেউ কখনো বানিয়েছিলেন বলে আমার জানা নেই। এক ষোড়ষী, চপলা, সুন্দরী কামাতুরা নারী বাঁ পা এগিয়ে আগ্রাসী এবং লাস্যময়ী ভঙ্গিতে অগ্রসর। তাঁর এক হাতে তরবারি আর অপর হাতে তাঁর নিজের কাটা মুন্ডু। তাঁর বক্ষবন্ধনী পদ্মের এবং বাকি শরীর নিরাবরণ। তাঁর মাথার উপরে মণি সাপ দিয়ে বাধা। তাঁর মুন্ডহীন ধড়ের থেকে নির্গত হচ্ছে তিনটি রক্তধারা। একটি পান করছেন তিঁনি নিজে এবং অপর দুটি তাঁর দুই অপরূপা সখিরা। এই সমগ্র আসনটি হচ্ছে যোনি আকৃতির একটি আসনে। আসনের সীমানায় পদ্মফুলের সারি। আর আসনের মধ্যে মায়ের পায়ের তলায় কামদেব ও রতি বিপরীত যোনী মুদ্রায় সঙ্গমরত।  ইনি দশমহাবিদ্যার এক বিদ্যা কিন্তু এনার প্রাদূর্ভাব হয় সৃষ্টিচক্রের নিয়মের গোলমাল হলে। যদি সৃষ্টিচক্রে ধ্বংসের পরিমান সৃষ্টির থেকে বেড়ে যায় তখন প্রাদূর্ভাব হয় ছিন্নমস্তার। এনার পূজো বলি ছাড়া হয় না। মন্দির চত্বরে বলিদান চত্বরে নিয়মিত পাঁঠা বলি হয়। পান্ডার দোকানের পূজার স্ট্যান্ডার্ড থালিতে একটা নারকেল থাকে। নারকেলটা বলি দিতে হয় মানে এক আছাড়ে ভাঙতে হয় পাঠা বলির পাশেই একটা নির্দিষ্ট চত্বরে। ছিন্নমস্তা কালী বা তারার মতো মঙ্গলময়ী নন। ছিন্নমস্তা ক্ষমতার প্রতীক – ক্ষমতা যে ক্ষমতা রাজার রাজা বানায়। হিরণ্যকশিপু ছিন্নমস্তার সাধক ছিলেন। ছিন্নমস্তা ধ্বংসের প্রতীক – সেই ধ্বংস যাকে প্রতিরোধ করতে বিষ্ণুকে অবতার রূপ গ্রহণ করতে হয়। প্রহ্লাদের অছিলায় বিষ্ণুকে নিজেকে আসতে হয় নৃসিংহ সেজে। এই ছিন্নমস্তার, তার মন্দিরের যাওয়ার অন দি রোডের জপমালাটা কি?
অন্তরঙ্গ যাত্রাপথের লিখিত রূপ নেই। কেবলমাত্র গুরুমুখে শ্রুতির মাধ্যমে প্রাপ্ত। এযাবৎকাল এই হয়ে এসেছে। খুব উপর উপর দেখলেও কয়েকটা কারণ সহজেই বোঝা যায় যেমন – এই যাত্রাপথে সাধকের এমন কিছু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় যেসব যে বা যারা এই পথের কোনোদিন ছায়াও মাড়ায়নি তাদের পক্ষে বোঝা অসম্ভবতো বটেই এমনকি তারা ভয় পেয়ে যেতে পারে বা পাগোল ভাবতে পারে বা ওই যাতীয় যাতা হতে পারে আরকি। লেখার মজা এই যে একবার লেখা হলে পাঠকের অর্থাৎ কে পড়বে আর কে পড়বে না তার উপর লেখকের আর কোনো কন্ট্রোলই আর কাজ করে না। ফলে গোলমাল হয়ে যেতে পারে আর কি। শ্রুতির কিন্তু এই সমস্যাটা নেই। পাত্রকে গুরু একেবারে বিচার করে নিয়েই রহস্য ভেদ করেন। এর ফলে জপমালা খোজার প্রজেক্টে এমনকি একটা রেফারেন্স মেটিরিয়াল পর্যন্ত পাওয়া যায় না।
ছিন্নমস্তার একটা দর্শন মানে ফিলোজফি অবশ্যি আছে কিন্তু সেটা তো হয়ে গেল বেদের সিনোপসিস টাইপ। জপমালাটা দর্শন নয় বরং উপলধ্বি হতে পারে। এত কথা বলার পর আমার নিজের উপলধ্বিটা (এই মুহুর্তে) না বললে লেখাটা শেষ হবে না। আমার উপলধ্বিতে ছিন্নমস্তা চূড়ান্ত আত্মত্যাগের প্রতীক। খিদের মুখে খাবার না পেয়ে যে মা নিজেকে বলি দিয়েও বেঁচে থাকে তার সন্তানদের তাঁর নিজের রক্ত খাইয়ে জীবীত রাখার জন্য। সেই মা যার সামনে অনন্ত যৌবন, অনন্ত ভোগের হাতছানি। সেই মা যে মাতৃত্বের কর্তব্যকে পালন করতে গিয়ে নিতান্ত অবহেলায় মাড়িয়ে চলে যায় জীবের সবচেয়ে বড় বন্ধন – কামকে। এই আত্মত্যাগ করতে পারলে রুদ্রগ্রন্থি ছিন্ন হয় আর না পারলে অনন্ত প্রবৃত্তির ভোগে আপেক্ষমান থাকতে হয় কালের নিগ্রহের অপেক্ষায়। পরিবর্তনশীল জগতের অধিপতি কবন্ধ ছিন্নমস্তার ভৈরব। এতো ক্ষমতার টাকশাল – কতো চাই? ত্যাগের সমানুপাতে ক্ষমতা এই হিসাবে চলবে? শেষ কবে আত্মত্যাগ শব্দটা আমি উচ্চারণ করেছি নিজেরই মনে নেই। জপমালাটা আর খুঁজে পেলাম না – এতটাই বলতে পারছি, বাকিটা ব্যাক্তিগত।
 

আম্বেদকার - গান্ধী - একটি সাক্ষাতকার

ডা: বাবাসাহেব আম্বেদকারের এই সাক্ষাতকারটি বিবিসিতে প্রচারিত হয় ৩১/১২/১৯৫৫ সালে। আজকের দিনে দলিত আন্দোলন, হিন্দুত্ব, সংরক্ষন এবং গান্ধীবাদের বিভিন্ন সংমিশ্রন যখন ২০১৪র লোকসভা ভোটের আগে পরে দেখা যাচ্ছে তখন সেই মানুষটি যিনি এখনও দলিতদের কাছে গর্ব তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক আশা ভরসার রক্ত মাংসের ছবি, তিনি কি ভাবতেন মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে? কেমনভাবে একজন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসাবে তিনি দেখেছিলেন গান্ধীকে? এই বিনির্মান বা অতিনির্মানের যুগে দাঁড়িয়েও শুধু তার কথাটুকু শুনলেই মনে হবে এ যেন আজকের কথা... এ ইতিহাস হয়তো লেখা হবে না পাঠ্য পু্‌স্তকে। চেতনা লহরের সূত্রে কোথাও কেউ মনে করুন এই ইতিহাসকে সেকথা ভেবেই সাক্ষাৎকারটির মোটামুটি সৎ একটা অনুবাদ করা হল।  
গান্ধীর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় ১৯২৯ সালে, এক বন্ধুর মাধ্যমে। আমাদের এক বন্ধু মি: গান্ধীকে অনুরোধ করেন আমার সাথে আলাপ করার জন্য। মি: গান্ধী  আমাকে চিঠি লেখেন এবং আমার সাথে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমিও যাই ওনার সাথে দেখা করতে। সে সময়টা ছিল ১৯২৯, প্রথম গোলটেবিল বৈঠকের ঠিক আগে। প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে গান্ধী আসেননি। কিন্তু তারপর দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে উনি আসেন। সে সময় উনি প্রায় পাঁচ ছয় মাস ছিলেন। সে সময় আমি ওনার সাথে অনেকবার দেখাও করেছিলাম এবং রাজনৈতিকভাবে মুখোমুখিও হয়েছিলাম। এরপর পুনা চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই উনি আমাকে দেখা করতে অনুরোধ করেন। তখন উনি জেলে। আমি দেখা করেছিলাম। এই সমস্ত সময়গুলিতেই আমি গান্ধীর সাথে দেখা করেছিলাম।  এ প্রসঙ্গে একটা কথা আমি বলতে চাই – আমি গান্ধীকে দেখেছি তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসাবে। কখনো কখনো আমার মনে হয় এভাবে দেখাতে আমি ওনাকে অনেকের চেয়ে অনেক ভালো চিনতে পেরেছি। গান্ধীকে আমি দেখতে পেয়েছি একজন মানুষ হিসাবে, তার ভেতরের মানুষটাকে। যারা তার কাছে গিয়েছিলেন শিষ্য হিসাবে তাঁরা তাঁর সেই রূপ কখনোই দেখতে পাননি। তাঁরা শুধু তাঁর বাইরের রূপটুকুই দেখেছে যেখানে তিনি মহাত্মা। আমি আবার বলব আমি মহাত্মা গান্ধী নয় মানুষ গান্ধীকে দেখেছি যা তাঁর শিষ্যগন দেখতে পাননি।
বিবিসি – আপনি কিভাবে আপনার দেখাকে ব্যাখ্যা করবেন?
আ: স্বীকার করতে অসুবিধা নেই যে আমি বেশ খানিকটা অবাকই হই যখন দেখি পৃথিবীর লোকেরা, বিশেষত পাশ্চাত্যের পন্ডিতরা যখন গান্ধীকে নিয়ে এতটা মাতামাতি করছেন। আমি এটা বুঝতে পারিনা। এটুকু বলতে পারি, ভারতের ইতিহাসের ক্ষেত্রে, গান্ধী ছিল একটা অধ্যায়ের নাম, আর কিছু নয়। মানুষের স্মৃতি থেকে গান্ধী ইতিমধ্যেই বিদায় নিয়েছেন। মানুষের মনে গান্ধীর যেটুকু স্মৃতি অবশিষ্ট আছে তা আছে কারণ কংগ্রেস পার্টি প্রতি বছর গান্ধীর জন্মদিনে জাতীয় ছুটি দেয় আর এছাড়া তার জীবনের বিভিন্ন দিনগুলি পালন করে। সপ্তাহকালব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে গান্ধীর স্মৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু এইসব কৃত্রিম মাতামাতি না থাকলে, আমার মনে হয় গান্ধী অনেক অনেক আগেই জনগণের স্মৃতি থেকে বিদায় নিতেন।  
বিবিসি – আপনি মনে করেন না উনি ভারতীয় রাজনীতিতে কোনো মৌলিক পরিবর্তন এনেছিলেন...
আ: না না, আদৌ না। এমনকি আসলে উনি সবসময়ই দুরকম কথা বলে গেছেন। উনি দুটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন – একটি ইংরাজি (দি হরিজন) আরেকটি গুজরাটি। আপনি যদি ওনার প্রকাশিত দুটি পত্রিকাই পড়েন তাহলে আপনি দেখতে পাবেন কিভাবে উনি মানুষকে ভুল বুঝিয়েছিলেন। ইংরাজি কাগজে উনি জাতপাত, অস্পৃশ্যতার বিরোধী, গণতন্ত্রের পূজারী। কিন্তু গুজরাটি কাগজে উনি সেই চেনা ছকের কথা বলেন – জাতপাত ও বর্ণাশ্রমের সমর্থক, সেই সমস্ত পুরনো গতানুগতিক ভাবনা যা ভারতবর্ষকে পিছনে টেনে ধরে রেখেছে তার সমর্থক। কেউ যদি গান্ধীর জীবনী লিখতে চান তাহলে তিনি যদি শুধু গান্ধীর ইংরাজি আর গুজরাটি লেখার একটা তুলনামূলক আলোচনা করেন তাহলেই একটা বড় কাজ করা হবে। পাশ্চাত্যের সব পন্ডিতরা শুধু গান্ধীর ইংরাজি লেখাই পড়েন আর ভারতের মানুষকে তাদের ভাষাতে গান্ধী কি বলেছিলেন সে খবর তাদের অজানাই থেকে যায়।    
বিবিসি – তাহলে ওনার আসল ইচ্ছা কি ছিল SC/ST বিষয়ে?
আ:- দেখুন বিগত ২০০০ বছর ধরে আমরা অস্পৃশ্যতার বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। কেউ কোনোদিন এপ্রসঙ্গে কোনও কথা বলেনি। আমরা চাই অস্পৃশ্যতার অবসান। কিন্তু শুধু অস্পৃশ্যতার অবসান সমস্যার সমাধান নয়আমাদের দরকার সমান সুযোগ যাতে আমরা উঠে আসতে পারি বাকি জাতগুলির সমকক্ষ হতে পারি। শুধুমাত্র ছোযাছুয়ির বেলাতেই নয়, আমাদের দরকার সুযোগ যাতে আমরা বড় সরকারী চাকরি পেতে পারি সরকারের নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারি। এবিষয়ে গান্ধী আমাদের পুরোপুরি বিরোধী ছিলেন। একেবারেই পুরোপুরি বিরোধী।
বিবিসি – উনি শুধু মন্দিরে প্রবেশ অধিকার নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন...
আ: একদম তাই। শুধু মন্দিরে প্রবেশ অধিকার। দেখুন মন্দিরে প্রবেশ অধিকার নিয়ে অচ্ছুতদের খুব বেশি মাথাব্যথা নেই। আমি হিন্দু মন্দিরে প্রবেশ অধিকার পেলাম অথচ আমার গ্রামে আমি পড়ে রইলাম বাইরে অস্পৃশ্য হিসাবে। একসময় হিন্দুরা অচ্ছুতদের ট্রেনে চড়তে দিত না কিন্তু আজ সে অবস্থা নেই – তাতে কি খুব বেশি কিছু যায় এসেছে কারো? 
বিবিসি – আপনি বলতে চান উনি অচ্ছুতদের অবস্থার কোনও মৌলিক পরিবর্তন চাননি...
আ: একদম ঠিক।  ওনার হরিজন আন্দোলন আসলে কেবলমাত্র হরিজনদের কংগ্রেসে নিয়ে আসার একটা মামুলি ছক ছাড়া কিছুই না। এছাড়াও একটা ব্যাপার ছিল, উনি চেয়েছিলেন যেন কোনোভাবেই হরিজন আন্দোলন ওনার স্বরাজের মুখোমুখি না দাঁড়ায়। উনি গ্যারিসন নন যিনি আমেরিকাতে নিগ্রোদের অধিকারের প্রকৃত লড়াই লড়েছিলেন।
বিবিসি -  আপনি কি মনে করেন রাজনৈতিক স্বাধীনতা গান্ধী ছাড়াও আসত?
আ: অবশ্যই।  স্বাধীনতা আসবারই ছিল। হয়তো তা হতো আর একটু ধীর গতিতে এবং তাতে ভারতের আপামর জনগণের আরও ভালোই হতো! সেক্ষেত্রে বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলি নিজেদের ঘর গুছানোর আরও খানিকটা সময় পেত। আজ (১৯৫৫ সালে - অনুবাদক) দেখুন হঠাৎ করে পাওয়া স্বাধীনতা নিতে এই সমস্ত জনগোষ্ঠীগুলি আদৌ তৈরিই হতে পারেনি।
বিবিসি – আপনি কি মনে করেন গান্ধী কংগ্রেসের রাজনৈতিক স্বার্থ দেখেছিলেন স্বাধীনতার সময় নির্বাচনের ক্ষেত্রে?
আ: - দেখুন এটা আমি জানিনা। তবে এটুকু বলতে পারি যে আমি জানিনা মি অ্যাটলে (Clement Richard Attlee সে সময় ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, লেবার পার্টি – অনুবাদক) হঠাৎ কি করে রাজি হয়ে গেলেন স্বাধীনতা দিতে। এটা একটা সিক্রেট। আশা করি ভবিষ্যতে কোনো একদিন মি: অ্যাটলে নিশ্চয়ই সে রহস্য উন্মোচন করবেন তার আত্মজীবনীতে কেউ এটা আশা করেনি, হঠাৎ করে কি ঘটনা ঘটল যাতে এমন তাড়াহুড়োর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা করতে হলো। আমার ব্যক্তিগত মতামত যদি বলেন তাহলে বলতে পারি দুটি বিষয় এক্ষেত্রে কাজ করেছিল। প্রথমত, ব্রিটিশ শাসন নিশ্চিন্ত ছিল যে ব্রিটিশ রাজের প্রতি সেনাবাহিনীর আনুগত্য অটুট থাকবে। সে ধারনাটা একটা বড় ধাক্কা খায় সুভাষ চন্দ্র বোসের কাছে। সেনাবাহিনীর মধ্য বিদ্রোহ এক বাস্তব সম্ভাবনা হয়ে উঠছিল। এক্ষেত্রে ভারতে শাসন চালাতে গেলে ব্রিটিশকে অনেক অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হতো ইউরোপিয়ান সেনা পুষতে। অর্থাৎ সেই ১৮৫৭র সিপাহী বিদ্রোহের পরিস্থিতি। আর তাছাড়া ভারতবর্ষের বিশালতা মনে করলে, এত বড় দেশকে ব্রিটিশ সেনা দিয়ে দমন করতে গেলে যত সেনা লাগত তা ইংল্যান্ডের পক্ষে যোগানোও সম্ভব ছিল না। এছাড়া যে বিষয়টা শাসকের মধ্যে কাজ করেছিল তা হলো তার ব্যবসা এবং পুঁজির স্বার্থ সুরক্ষিত করা। যদি ভারত রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীন হয়েও যায় কিন্তু ব্রিটিশ পুঁজি ভারতীয় শাসকদের হাতে সুরক্ষিত থাকে তাহলে অসুবিধা কোথায়? বরং সেটা মেনে নিয়ে সেরকমভাবে পরিকল্পনা করাটাই বাস্তবোচিত এবং বুদ্ধিদীপ্ত!
বিবিসি – পুনা চুক্তির সময় আপনার এবং গান্ধীর মধ্যে কি কথা হয়েছিল সে বিষয়ে যদি কিছু বলেন(২৪শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ সালে পুনের ইয়েওয়াড়া জেলে গান্ধী এবং আম্বেদকরের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এর বিষয় ছিল স্বাধীনতাত্তোর ভারতের সংবিধানের পরিকল্পনা এবং সেখানে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীগুলির আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব। এবিষয়ে আম্বেদকারের সাথে গান্ধীর চরম বিরোধ হয় কারণ গান্ধী অচ্ছুতদের আলাদা প্রতিনিধিত্ব স্বীকার করতে চাননি। পরে অবশ্য তাকে আম্বেদকারের যুক্তির সামনে হার মানতে হয়। এই মর্মে স্বাক্ষরিত চুক্তি ইতিহাসে পুনা চুক্তি নামে বিখ্যাত)
আ:- ম্যাকডোনাল্ডের (Ramsay MacDonald, ১৯৩২ এ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) প্রাথমিক খসড়ায় উনি আমার প্রস্তাব মেনে নেন।  আমি বলেছিলাম দেখুন হিন্দুরা অচ্ছুৎদের আলাদা প্রতিনিধিত্ব চায় না কেননা তা নাকি জাতীয় সংহতির পরিপন্থীকিন্তু আমরা, দলিতরা মনে করি যে যদি আমাদের আলাদা প্রতিনিধিত্বের অধিকার না থাকে, তবে আমরা উঁচু জাতের নীচে চাপা পড়ে যাব। আর পিছড়ে বর্গের প্রতিনিধি হিসাবে যে থাকবে সে পরিণত হবে উঁচু জাতের বাবুদের চাকরে। আমাদের আলাদা প্রতিনিধিত্বের অধিকার পেতেই হবে। আমি আরো বলেছিলাম আমাদের দুটো ভোট থাকুক – একটা নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার আর একটা সাধারণ নির্বাচনের ভোটাধিকার সেক্ষেত্রে আর জাতীয় সংহতির কোনো সমস্যা থাকছে না। আমি বলেছিলাম সারা জীবন দলিতদের হিন্দুদের থেকে আলাদা হয়ে থাকতে হয়, কোনো রকম সামাজিক বা ধর্মীয় মিশ্রণের প্রশ্নই নেই হঠাৎ পাঁচ বছরে এক দিনের ভোট যজ্ঞে এক হিন্দুদের সাথে একসাথে ভোট উৎসবে যোগদানের মধ্য দিয়েই কি জাতীয় সংহতির বিকাশ ঘটে যাওয়া সম্ভব? এ হতে পারে? এটা কি বোকার মতো চিন্তা নয় যে দুটো লোক এক সাথে একই বুথে ভোট দেওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের হৃদয় পরিবর্তন হয়ে যাবে? একারণেই আমি ওনাকে (ম্যাকডোনাল্ডকে) বলেছিলাম আমাদের দুটো ভোট দিন। Communal Award  ও আমার প্রস্তাব ছিল যা ম্যাকডোনাল্ড গ্রহণ করেন। কিন্তু গান্ধী কখনোই চাননি আমরা দলিতরা আমাদের নিজেদের প্রতিনিধিত্বের অধিকার পাই। সুতরাং উনি অনশন শুরু করে দিলেন। কিন্তু ম্যাকডোনাল্ড বললেন Communal Award  জাতীয় সংহতির পরিপন্থী নয় বরং বিভিন্ন জাতিগুলিকে কাছে আনার চেষ্টা আর তাই সরকার একে প্রত্যাহার করবে না। কিন্তু গান্ধী অটল। উনি বললেন ভারতে আমি শুধু তিনটি জাতিকে স্বীকৃতি দিতে পারি – হিন্দু, মুসলিম এবং শিখ। রাষ্ট্র কেবলমাত্র এই তিনটি জাতিকেই স্বীকার করবে তার সংবিধানে। খ্রিস্টান, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বা দলিত জাতিগুলিকে সংবিধান স্বীকার করবে না। তাদেরকে মিশে যেতে হবে অন্য জাতির মধ্যে। এরকম অদ্ভুত কথা এমনকি তার বন্ধুরাও সমর্থন করতে পারেননি। তারাই প্রশ্ন তুললেন – আচ্ছা আপনি যদি মুসলমান এবং শিখদের আলাদা স্বীকৃতি দিতে সম্মত হন যারা দলিতদের থেকে অন্তত ১০০০ গুন বেশি শক্তিশালী রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে, তাহলে দলিতদের আপনি ভুলে যান কি করে? এ প্রশ্নের তার একটাই জবাব ছিল – তোমরা আমাদের সমস্যা বুঝবে না – ব্যাস এইটুকুই। মি আলেকজান্ডার এবং তার অনুগামী এক ফরাসী মহিলা, নামটা স্মরণে আসছেনা এখুনি, গান্ধীর সাথে এক বড় বিবাদে জড়িয়ে পড়েন এবিষয়ে। তারা বলেন, দেখুন আপনি যদি বলেন কোনো জাতি বর্ণ বা ধর্মের কোনো উল্লেখ বা স্বীকৃতি সংবিধানে থাকবে না তাহলে সে কথার একটা মানে হয় এবং সেটা গণতান্ত্রিক। কিন্তু আপনি যদি বলেন শুধু বেছে বেছে হিন্দু, মুসলমান আর শিখদের স্বীকৃতি থাকবে তবে তার কোনো মানে হয় না। গান্ধী কোনো উত্তর দিতে পারেননি। গান্ধী আদৌ দলিতদের প্রতিনিধিত্ব স্বীকার করতেই প্রস্তুত ছিলেন না। তার নিজের উপদেষ্টামন্ডলীই তখন তাকে বলেন যে এতটা গোঁড়ামি কেউই সমর্থন করবে না। সে সময় মি মালব্য (মদন মোহন মালব্য – অনুবাদক) আমার কাছে আসেন একটা আপোষ রফার জন্য। আমি ওনাকে বলি দেখুন আমি ব্রিটিশের সাথে লড়াই করে দলিতদের যে অধিকার আদায় করেছি তা গান্ধীর সাথে রফার স্বার্থে জলাঞ্জলি দিতে পারবো না। যাইহোক একটা আপোষ রফার সূত্র আমি প্রস্তাব করি। দলিতরা তাদের তরফ থেকে চার জন প্রতিনিধিকে আগে নির্বাচন করবে যারা সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। এবং স্বাভাবিকভাবেই এদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় যে সেই শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত হবে। এর মধ্য দিয়ে অন্তত এটুকু করা যাবে যে উঁচু জাতের লোকেরা দলিতদের প্রতিনিধিকে তাদের ইচ্ছামত নির্বাচন করতে পারবে না। এই প্রস্তাব আর গান্ধীর পক্ষে খারিজ করা সম্ভব হয়নি। এই ফর্মুলায় একটিই মাত্র নির্বাচন হয়েছিল ১৯৩৭ সালে এবং সেখানে গান্ধীর মনোনীত একজন প্রার্থীও জয়ের মুখ দেখেননি।
বিবিসি – গান্ধী কি এবিষয়ে দর কষাকষি করেছিলেন?
আ: - ভয়ঙ্কর রকম! আমি ওনাকে বলেছিলাম দেখুন আমি আপনার জীবন এবং সম্মান বাঁচাতে চাই কিন্তু তা আমার দলিত ভাইদের বলি দিয়ে নয়। আপনি বলুন শুধুমাত্র পাঁচ বছরে একদিন একটা সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়ে কিভাবে মানুষের জীবনের তার সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন হতে পারে?
বিবিসি – এর জবাবে উনি কি বলেছিলেন?
আ:- উনি কিছুই বলতে পারেননি। উনি ভয় পেয়েছিলেন যে একদিন দলিতরা সমান শক্তিশালী হয়ে উঠবে শিখ এবং মুসলিমদের মতো এবং হিন্দুরা একা হয়ে যাবে, কোণঠাসা হয়ে যাবে যখন দলিত, মুসলিম, শিখ এবং অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতিগুলি মাথা তুলে দাঁড়াবে।
বিবিসি – এবিষয়ে উনি একজন সাধারণ রাজনৈতিক নেতার মতই আচরণ করেছিলেন মহাত্মা হিসাবে নয়।
আ: - একদমই তাই। উনি একজন হিন্দু রাজনৈতিক নেতা ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না। আমি কোনোদিন ওনাকে মহাত্মা বলে সম্বোধন করিনি, আমি মনে করি না উনি মহাত্মা ছিলেন। এমনকি নৈতিকতার বিচারেও আমি ওনাকে মহাত্মা বলতে পারবো না।

    

মার্কেজ বৃত্তে গিনিপিগ জীবন

মার্কেজ বৃত্তে গিনিপিগ জীবন
আচ্ছা বলতো, সেন্টিগ্রেড আর ফারেনহাইটের মধ্যে কোনটা বেশি sensitive? কেনেডি স্যর প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন ব্যাচের উদ্দেশ্যে। ব্যাচে আছে নাইন টেন মিলিয়ে জনা দশেক ছেলেমেয়ে যার মধ্যে আছি আমি (নাইন), আর ক্রাইস্ট চার্চ গার্লসের ক্লাস নাইনের ফার্স্ট গার্ল অনন্যা।  আমি বললাম ফারেনহাইট ওটা প্রায় সেন্টিগ্রেডের ডাবল sensitiveএকদম ঠিক ধরেছিস- এই ইন্দ্রনীলটা না বেশ ইনটেলিজেন্ট ছেলে কেনেডি স্যরের স্বতঃস্ফূর্ত প্রশংসায় সবাই কেমন একটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল যদিও উত্তরটা প্রায় কারো কাছেই বোধগম্য হয়নি তবুও কেউ আর মুখ ফুটে সে কথা বলতে পারল না। এরপর কথাটা কেমনভাবে যেন হারিয়ে গেল কেননা এটার থেকে কোনো ছোটো বা বড়ো প্রশ্ন-উত্তর বোধহয় হয় না।
ব্যাচ শেষ হয়ে গেলে অনন্যা আমাকে ধরল। অ্যাই, ওটা কি বললি রে? আমি বললাম দেখ জল যে তাপমাত্রায় বরফ হয় এবং ফোটে সেই পয়েন্ট দুটো তো ফিক্সড। এবার সেটা সেন্টিগ্রেড বলছে ০ আর ১০০ আর ফারেনহাইট বলছে ৩২ আর ২১২। মানে ধর একই দৈর্ঘ্যের একটা সরলরেখাকে সেন্টিগ্রেড ভাঙছে ১০০ ভাগে আর ফারেনহাইট ভাঙছে ১৮০ ভাগে। মানে ধর ১:১.৮ প্রায় ডবল হলো না? 
সন ১৯৮৫, সেই প্রথম পাখীর নীড়ের মতো চোখ তুলে তাকিয়েছিল অনন্যা আর স্প্যানিশে প্রকাশিত হয়েছিল লাভ ইন দা টাইম অফ কলেরা

Ø

একটা স্বপ্নের গল্প করা যাক। মার্কেজ এই স্বপ্নের বিবরণটা দিয়েছেন Strange Pilgrims এর ভূমিকায়। (অনুবাদ আমার)।
আমি দেখলাম আমি আমার নিজের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করছি, ঘুরে বেড়াচ্ছি বন্ধুদের সাথে। ওরা সব বিষণ্ণ সাজপোশাকে সজ্জিত কিন্তু সবটা মিলিয়ে কেমন যেন একটা উৎসব উৎসব আমেজ। আমরা সকলেই খুব খুশী আবার অনেকদিন পর একসাথে হতে পেরে। আমি বিশেষভাবে বোধহয় সবার চেয়ে বেশি খুশি ছিলাম, কেননা আমার কোনো ধারনাই ছিলনা মৃত্যু এরকম একটা সুযোগ আমাকে দেবে আমার সমস্ত লাতিন আমেরিকার বন্ধুদের সাথে মিলিত হবার। সেই সব বন্ধুরা যারা আমার সবচেয়ে পুরনো আর কাছের বন্ধুরা। কত কত দিন ওদের সাথে দেখা হয়নি, কি ভালোই না লাগছে। যাই হোক অন্ত্যেষ্টি পর্ব ভালোয় ভালোয় মিটে গেল। এবার ফিরে যাবার পালা। একপা দুপা করে আস্তে আস্তে সবাই যেতে শুরু করল। আমিও যাবার জন্য পা বাড়ালাম। কিন্তু তখনই তন্ময়, আমার প্রিয়তম বন্ধু এসে এক নিশ্চিত কাঠিন্যের সাথে আমাকে এসে বললো তুই তো আর ফিরতে পারবি না। তোর পার্টি এখানেই শেষ। কেবলমাত্র তুইই ফিরতে পারবিনা আর বাকি সবাই ফিরে যাবে। এটাই নিয়ম- ঠিক তখনই, তখনই আমি অনুভব করলাম মৃত্যু মানে বন্ধুদের সাথে আর দেখা না হওয়া।
আমার মৃত্যু হয়নি। কিন্তু তাও আমি কি বন্ধুদের সাথে আছি? প্রশ্নবোধক চিহ্নটাই বলে দিচ্ছে আমি নিঃসন্দেহ নই। হয়তো কোনোদিন ছিলামও না বন্ধুদের সাথে হয়তো কেউ আমার বন্ধু ছিলই না, কিন্তু তুমি ছিলে। ভাবতে ভালো লাগে আজও আছো। আমার ইতিহাসতো আমার Fermina Daza সেই তোমারই গল্প। একটু বড় হয়ে রাই বা অর্ক যদি কখনো জানতে চায় আমাদের সময়ের গল্প, যদি শুনতে চায় তাহাদের এক হেজে যাওয়া confused.com প্রজন্মের ইতিহাস, কি বলবো ওদের? মমতা? মোদী, সিপিএম, নকশাল বা আপ এর গল্প? হাই তুলে ওরা বলবে এইরে, মালটা আবার শুরু করলো .... যদি বলি আমাদের সময় আমরা মার্কেজ নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম তাহলে ওরা হয়তো বলবে পিতৃদেব, ইহার ফলে আমাদের কয়টি কেশ উৎপাটিত হইল?  আমি মনোরন্জ্ঞন ব্যাপারী নই। একজন দলিত সেল্ফ এডুকেটেড চন্ডাল নই যিনি নিজের জীবনবৃত্তান্তকে উত্তরিত করেন এক বৃহত্তর রাজনৈতিক চেতনায়। তার জীবনকথা ইতিবৃত্তে চন্ডাল জীবন হয়ে ওঠে এক শ্রেনীর মুখপত্র। শ্রেনী, যে শ্রেনী আজও বঞ্চিত, সমাজিকভাবে, ঐতিহাসিকভাবে শোষিত। কিন্তু শ্রেনী বলেই সে ক্ষমতার দাবীদার। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। পাশা উল্টে গেলে এই ক্ষমতাই তার দাসত্ব করবে। ভূখা মানুষ, বই ধর, ওটা হাতিয়ারতাই প্রায় লুপ্তপ্রায় বিপ্লবী প্রজাতির ঝোলায় পাওয়া যায় ইতিবৃত্তে চন্ডাল জীবন
গিনিপিগের কোনো শ্রেনী হয়না। গিনিপিগ কখনো দল পাকাতে পারেনা। সে এতটাই সাধারন বা বলা যায় predictable যে একটি গিনিপিগের উপর পরীক্ষা করেই সমস্ত প্রজাতির ব্যবহারের দিক নির্দেশ পাওয়া যায়। আমি একজন গিনিপিগমাত্র। লাতিন আমেরিকাতে তৈরি স্প্যানিস ড্রাগ মার্কেজের প্রভাব তৃতীয় বিশ্বের কলকাতার যে অসংখ্য গিনিপিগের উপর ফেলা হয়েছিল, তাদের একজন মাত্র। ড্রাগ expire করে গেছে সুতরাং প্রভাব সম্পর্কিত রিপোর্টটি এখন প্রকাশ করতে আর বাধা নেই। আলোচ্য গিনিপিগকে বাল্যকালে বিবেকানন্দ এবং সদ্য-কৈশোরে যথাসময়ে সাম্যবাদের টীকা দেওয়া হয়েছিল।      

              Ø


মার্কেজ নোবেল পেয়েছিলেন। ভাগ্যিস পেয়েছিলেন! নয়তো কলকাতার উপকণ্ঠে দমদমে বসে আমি তার নাম জানতে পারতাম না। সেটা ১৯৯১ সাল। বইমেলা থেকে সংগ্রহ করার তালিকায় যুক্ত হলো গ্যাব্রিয়েল গার্সেয়া মার্কেজ। কেন কি ব্যাপার জানার দরকার নেই আপাতত কামু, কাফকা, সার্ত্রে আর মার্কেজের কালেকশন বানিয়ে নিতে হবে। হাতে এলো অনেককটা বই, কিন্তু মন টানল প্রথম লাভ ইন দা টাইম অফ কলেরা
১৯৮৫র সেন্টিগ্রেড ফারেনহাইটের পেরিয়ে তখন আমরা অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছি। অনন্যা কমার্স নিয়ে গোয়েঙ্কাতে পড়ছে, মাধ্যমিকে ফাটাফাটি দারুন রেজাল্ট করার পরও! আমার খুব অবাক লেগেছিল তুই সাইন্স নিলি না? কি করে পারলি? ও জবাব দিয়েছিল কেরিয়ারটা প্ল্যান করতে হয়, আমার CA করার প্ল্যান আছেধাক্কা খাচ্ছিলাম, বুঝতে পারছিলাম বিপ্লবী রোমান্টিকতার একটা নির্দিষ্ট ফরমাট আছে তার বাইরে সে একেবারেই অচল একটা বোঝা মাত্র।
সুতরাং পরিকল্পনামাফিক এই অবস্থানের গিনিপিগটির উপর প্রয়োগ করা হলো  লাভ ইন দা টাইম অফ কলেরাপড়লাম। একদম ছিটকে ছ হয়ে গেলাম। এটা কি? আমি মনে করতাম প্রেম নিয়ে আমি তুমি ও সে এই থিমে পার-মিউটেশন আর কম্বিনেশনের সমস্ত প্লট আমি apprehend করতে পারি। সুতরাং এদিক থেকে প্রেমে নতুন কোন মাত্রা আর যোগ করতে কেউ কোনোদিন পারবেনা অন্তত আমার কাছেকিন্তু সে ভাবনা এসে ধাক্কা খেল Florentino Arizaর কাছে। বিশ্বাস আর ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করা যায় একান্ন বছর নয় মাস আর চার দিন। সেতো আসবেই। তাকে আসতেই হবে
তখন জীবনের লক্ষ্য প্রফেশনাল বিপ্লবী হবার। সেখানে অনন্যা নেই থাকবে না সেটা ও খুব পরিষ্কার করেই বলে দিয়েছে। বুঝতে পারছিলাম এই পণ্য, বাজার সংস্কৃতি, বাস্তবতা এইসব ভারী ভারী কথাগুলি এক অনিবার্যতার জন্ম দিয়েছে। এ যেন আর এক Chronicle of a death foretoldআমার জীবন লেখা হয়ে গেছে লাভ ইন দা টাইম অফ কলেরা-তে।

              Ø


She did everything in a methodical solemn way, as if nothing unforeseen had happened to her since her birth. – Sleeping beauty and the Airpalne - Marquez
সন ১৯৯৫: নিখুঁত পরিকল্পনায় ও পাশ করল CA inter. তারপর বিয়ে একেবারে নিখুঁতভাবেবিয়ের কথা বলতে গিয়ে খিলখিল করে হেসে ও বলেছিল এটা জাস্ট একটা চুক্তি you know; an agreement.  আমার আর দিলীপের কিছু মিউচুয়াল হিসাব নিকাশের সেটেলমেন্ট। তোর পথ আলাদা, তোকে আমি ভালোবাসি, অ্যাডমায়ার করি কিন্তু তোর সাথে তো আর লাইফের সেটেলমেন্ট করা চলেনা।
এদিকে নয়া অর্থনীতি চলে এসেছে হই হই করে। বুভুক্ষু সামন্ততান্ত্রিক গিনিপিগগণকে সরকারি উৎসাহে খাওয়ানো চলছে বাজার অর্থনীতি। মাঝে বুস্টার ডোজ সোভিয়েতের পতন ও পূর্ব ইউরোপের তাসের ঘর ভেঙ্গে পড়া।
দেবদাস হয়ে যাওয়ার অপশন নেই। বাবা জমিদার না। দু এক বোতল বাংলা জুটতে পারে কিন্তু তার বেশি কিছু আর না। সে সময় বরং গাঁজা অনেক সস্তায় পুষ্টিকর আমেজ দিয়েছে। কিন্তু গাঁজাতে ঠিক দেবদাসটার ভ্যালু পাওয়া যায় না আর চন্দ্রমুখীকে পাবার তো দুর দুর তক কোনো সম্ভাবনা নেই। আবার ফিরে যাই Florentino Arizaর কাছে।
অনন্যার সাথে আমার বইপত্র দেওয়া নেওয়া চলত। লাভ ইন দা টাইম অফ কলেরা-র এত গল্প করেছি ওর কাছে কত সময় মুখস্থ বলেছি কিন্তু বইটা ওকে দেওয়া হয়নি। শেষে একদিন বলেছিলাম যাহ, তোকে বইটা তোর বিয়েতে প্রেজেন্ট করবকথা রেখেছিলাম। ২৩শে জানুয়ারি, ১৯৯৫ বধূ-বেশী অনন্যার হাতে আমি তুলে দিয়েছিলাম আমার গিফট, এক কপি লাভ ইন দা টাইম অফ কলেরাভেতরে কি লিখব অনেক ভেবেছিলাম। বিয়ের প্রেজেন্ট সবাই হাতে নিয়ে দেখবে ফলে প্রায় দা ভিঞ্চি কোডে লিখতে হবে যা লেখার। অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত লিখলাম
With Feelings …
            Indranil

    Ø

Florentino Ariza on the other hand, had not stopped thinking of her for a single moment since Fermina Daza had rejected him out of hand after a long and troubled love affair after fifty one years nine months and four days ago.
আমি কিন্তু অপেক্ষার দিনগুলি গোনবার জন্য দেওয়ালে দাগ কাটতাম না। এমন কোনো দিনই যেত না যেদিন কোনো না কোনো কথা, ঘটনা, ভেসে আসা গান বা হঠাৎ মনে পড়া কবিতার লাইন অথবা হয়তো রাস্তার কুকুর কিংবা কারখানার পিছনের ভ্যাটের গন্ধ আমাকে অনন্যার কথা মনে পড়িয়ে দিত না
সে সময় আমি পাক্কা নকশাল। কারখানার গেটে গেটে ঘুরে কাগজ হক করছি আর স্বপ্ন দেখছি শ্রমিক শ্রেণীর স্বাধীন স্বতন্ত্র সংগঠন গড়ে তোলার। এইসব ছোটো ছোটো লড়াইগুলি ট্রেড ইউনিয়নের নেহাতই ছোট ছোট দাবী দাওয়া থেকে উত্তরিত হবে এক বৃহৎ পার্টি গঠনের সংগ্রামে ইত্যাদি ইত্যাদি ...
অতএব খারাইলোটা কি? মার্কেজের ম্যাজিক রিয়েলিজম আমাদের ঠিক কিভাবে দেখা উচিৎ? প্রশ্নটা করেই বুঝলাম নিতান্ত নাবালকের মত একটা কথা বলে ফেলেছি। আশীষদা স্মিতহাস্যে (আদর্শ কমিউনিস্টরা কখনোই লাউড নয় হাসিতেও একটা পরিমিতি আবশ্যক) বললেন ওটা তোমাদের পেটি বুর্জোয়া বিলাস। ব্যক্তি মানুষকে নিয়ে মাতামাতি আর বিচ্ছিন্নভাবে তাকে শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে এনে ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ নিয়ে বুর্জোয়া ভাববিলাস। তোমাদের কি বানর থেকে মানুষ-টা হয়ে গেছে? (আশীষদা বলতে চাইলেন আমাদের স্টাডি সার্কেলে এঙ্গেলসের বানর থেকে মানুষের বিবর্তনে শ্রমের ভূমিকা বইটি কি আলোচনা হয়েছে?)
না, মার্কেজ নিয়ে কোনোদিন আমাদের স্টাডি সার্কেলে আলোচনা হয়নি। আমার অতি প্রিয় বন্ধু তন্ময়কে বললাম আচ্ছা সংগঠনতো করবে না আমরা বন্ধুরা মিলে বসে একদিন আড্ডা দিলে হয় না মার্কেজ নিয়ে। ও বলল আমি তো তোর বন্ধু নই! আমরা কেউ কারো বন্ধু নই এখানে। এখানে আমরা সহযোগী একসাথে কাজ করছি একটা লক্ষ্যকে সামনে রেখে কমরেড শব্দটা ও ব্যবহার করল না, এড়িয়ে গেল হয়তো গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমি তখনো সেই স্তরে পৌছাইনি অথবা পেটি বুর্জোয়া ভাববিলাস আমার মনে যে পরিমাণ দাগ কেটে আছে তাতে ঐ শব্দটা Censored হয়ে গেল। আমার মধ্যে বোধহয় একটা শকের কোনো ছাপ দেখে থাকবে তন্ময়। সান্ত্বনা দেবার মত করে কিন্তু নীচু আর গম্ভীরভাবে ও বললো বন্ধুত্বের সম্পর্কের থেকে এ সম্পর্ক অনেক উন্নততর, আরো maturedএই নীচু গম্ভীর ভঙ্গির অর্থ হলো অতএব এ ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত এবং গৃহীত। এখনো যদি বুঝতে না পেরে থাকো, সেটাই স্বাভাবিক, তবে বড় হলে বুঝবেএ তন্ময় সংগঠনের তন্ময় সে তন্ময় আলাদা যে আমার বন্ধু। অনন্যার বিয়ের রাতে লাভ ইন দা টাইম অফ কলেরা প্রেজেন্ট করে এসে বাংলার বোতল নিয়ে বসেছি। আর.এন.গুহ রোডের মস্তানবাহিনীর (মানে লুম্পেন প্রলেতারিয়েত আর কি) এক স্যাম্পেল গ্লাসে মদ ঢালতে ঢালতে বললো ছাড়, ভুইলা যা, মদ খাআমার বন্ধু তন্ময় তখন বলেছিল, বৃহস্পতি সবচেয়ে বড় গ্রহ আর তাই তার উপরেই সবচেয়ে বড় বড় ক্ষতগুলো আছে। ভুলিস না, হৃদয়টাকে বৃহস্পতির মত বড় করে দে

    Ø

   
তাহলে প্রেম কি? আমার অস্তিত্ব কি? আর ম্যাজিক রিয়েলিজম? নাকি সবটাই পেটি বুর্জোয়া ভাববিলাস? অনেক প্রশ্ন উত্তর নেই। উত্তর নেই সেই আক্ষেপের ““Damn it,I said to myself with great scorn. Why wasn’t I born a Taurus!””!!!  এওতো মার্কেজের কথা। পাশের সিটে বসে যে ঘুমন্ত স্বপ্নসুন্দরীর সাথে মার্কেজ কাটিয়েছেন গত ৭ ঘন্টা তাকে যাত্রা শেষ হওয়ার মুখে শুধু একটিবার, একটিবারমাত্র ডাকতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন এরোপ্লেনের চাকা নিউ ইয়র্কের মাটি স্পর্শ করার আগে একবার শুধু তাকে জাগিয়ে দিতে। হয়তোবা পাখির নীড়ের মতো চোখদুটি খুঁজছিলেন, না আর সময় নেই, আট ঘন্টার যাত্রাপথ প্রায় সমাপ্ত... কিন্তু না পারলেন না, পারলেন না তাকে একটিবারের জন্য জেগে উঠতে বলতে! কিন্তু আশ্চর্য এইযে এই না পারাকে উনি বলছেন নক্ষত্রের চক্রান্ত! Taurus, অর্থাৎ মেষ রাশির জাতক না হওয়ার আক্ষেপ ধরা পড়ছে পেয়ারকে দুশমনের কাছে হেরে যাবার কারন হিসাবে! এটা কি? রিয়েলিটি? ম্যাজিক? না ম্যাজিক রিয়েলিটি? আবার কেউ কেউ বলবে আরে ছাড়ো তো, মদের খেয়ালে কি বলতে কি বলেছে আবার পরক্ষনেই উল্টো কথা বলবে
রিয়েলিজমের ছবি পাই মার্কেজের কাছেই। বুঝতে পারি তান্ত্রিক আর জ্যোতিষের কাছে শুধু আমাদের মত আধা সামন্ততান্ত্রিক (নাকি পুরো) ইত্যাদি সমাজের মানুষরাই দৌড়ায় নাসুদূর অস্ট্রিয়াতেও ভিয়েনাতে এক অভিজাত পরিবার দিন শুরু করে Frau Friedaর স্বপ্নাদেশ দিয়ে। সেখানকার অভিজাত এগিয়ে থাকা মানুষজনও সারা দিনের কর্তব্য জেনে নেয় Frau Friedaর কাছ থেকে। কোনো এক কিশোরের চকোলেটের উপর সেন্সর হয়ে চেপে বসে Frau Friedaর স্বপ্ন। মার্কেজ তুলে ধরেন সামাজিক পটভূমিকাকে। পরিষ্কার হয়ে যায় সামাজিক নিরাপত্তা-হীনতা কিভাবে চেপে বসে ব্যক্তি মানুষের বিশ্বাসের উপর। কিভাবে তা খুলে দেয় অসহনীয়তার দ্বার যেখান দিয়ে সশব্দে, সগর্বে প্রবেশ করে Frau Frieda আর আনন্দবাজারের জ্যোতিষ কলামের হরেক মাল। Santiago Nasarরা খুন হয় সাক্ষী থাকেন বিশপ! কোথায় যেন মিশে যায় কলকাতা আর ভিয়েনার বাস্তবতা। কিন্তু এতো সবটা নয়। আরো কিছু পড়ে থাকে। Frau Friedaকে উন্মোচন করার পর যখন বেশ আদর্শ বাস্তবতাধর্মী লোকশিক্ষামূলক গল্প প্রায় দাঁড়িয়ে গেছে তখনই একটা ধাক্কা। নেরুদার সাথে Frau Friedaর আলাপ। তারপর একই সাথে একই রাতে একই রকম স্বপ্ন দেখে ফেলেন নেরুদা আর Frau Friedaতবে কি .... ?
এসব প্রশ্ন কখনো সংগঠনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না কিন্তু আমার কাছে তো ছিল। সেই শুরু Point of departure এর....
   

    Ø

অনেকদিন অবধি ঠিক বিশ্বাস করতে পারতাম না পেঙ্গুইনের মার্কেজগুলো অরিজিনাল না অনুবাদ। পরে গল্পটা বুঝেছি। Edith Grossman মার্কেজের সাথে দীর্ঘ সময় একসাথে যাপন করেছেন। মাল খেয়েছেন, বাওয়ালি করেছেন যাতা আরকি। অনুবাদগুলো মার্কেজের সাথে বসে করা। মার্কেজের নিজের করা বহু অনুবাদ মিশে আছে ঐসব অনুবাদের মধ্যে। তাই অনেক ইচ্ছা থাকলেও সাহস পাইনা মার্কেজকে অনুবাদ করে বলতে।  একসময় সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের উপর খুব রাগ হয়েছিল ওনার লেখা কলেরার দিনগুলিতে প্রেম পড়ে। ভূমিকায় সন্দীপন লিখেছিলেন যে উনি মার্কেজের থেকে শুধু নামটাই নিয়েছেন উপন্যাসটা উনি তখনো পড়েননি। লাভ ইন দা টাইম অফ কলেরা আমার হৃদয়ের এত কাছে যে কলেরার দিনগুলিতে প্রেম পড়ে আমি রীতিমত সন্দীপন বিরোধী হয়ে গিয়েছিলাম। এই লেখায় বারবার ঘুরে ঘুরে আসছে বা আসবেও মার্কেজের বিভিন্ন লেখা কিন্তু তা সবই ইংরাজিতে কারন বহু ইচ্ছা থাকলেও অনুবাদটা আমার নির্মাণ করার ক্ষমতা নেই। 

    Ø


A novel is something where everything must be defined in the first paragraph: structure, tone, style, rhythm, length, and sometimes even the personality of a character. All the rest is the pleasure of writing, the most intimate, solitary pleasure one can imagine…
হুমম মার্কেজ এটা বললেন। তাহলে একবার আবার পড়া যাক লাভ ইন দা টাইম অফ কলেরার প্রথম প্যারাটা।
I T    W A S    I N E V I T A B L E: the scent of bitter almond always reminded him the fate of unrequited love. Dr. Juvenal Urbino noticed it as soon as he entered the still darkened house where he had hurried on an urgent call to attend a case that for him had lost all urgency many years before.
অর্থাৎ - ইয়ে তো হোনাহি থা। বার্লিন ওয়ালের ভেঙ্গে পড়া, চাওসেস্কুর পতন, সোভিয়েতের পতন সবই inevitable. আদর্শের মা মাসি ইয়ে হয়ে গেল... bitter almond এর গন্ধটা আশীষদা পেয়েছিল কিনা জানিনা কিন্তু পরে আমি আবার পেয়েছিলাম তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে আর একদম হালে নন্দীগ্রাম আর লালগড়ে। অর্থাৎ কিনা চাঁদ উঠেছে তারই পরে মানে বাকিটা ঔপন্যাসিকের লেখার আনন্দ। এখানে তিনি কে? ভগবান? ঈশ্বর? সময় অথবা অনন্যা? আচ্ছা, মহাভারতের প্রথম দুটো লাইনের কথা মনে আছে?
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান
।।
শুধু ক্ষমতা, ক্ষমতা দাও। কারন ক্ষমতা অমৃত। ক্ষমতার গল্প মহাভারত, তাকে পাবার জন্য যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ। সেই ক্ষমতা, যা বদলে দিতে পারে একটা জাতির রুটিন। টিভিতে মহাভারত চলবার সময় সারা ভারতে নেমে আসত এক অঘোষিত বনধ্। ক্ষমতার অমৃতে তৃতীয় শ্রেনীর একটি সিরিয়াল অমর হয়ে যায়। ক্ষমতার অমৃতে তাকে পাওয়া যায়। পৃথিবীর এইসব উঁচু মানুষদের দাবী এসে সবই নিয়ে যায়, নারীকেও নিয়ে যায়।
যা বেকার হ্যাজ হয়ে যাচ্ছে লেখাটাকি কিছু বোঝা যাচ্ছে? পাঠক যদি এরপরও টিকে থাকেন তাহলে বুঝবেন কিন্তু আর একটুক্ষণ, তারপর বলছি এটা কি বস্তু।
তা সে যা হোক, তাহলে আবার সেই একই প্রশ্ন খারাইলোটা কি? উপন্যাসের প্রথম লাইনকে সত্য করে তোলার মধ্য দিয়ে কি প্রমাণিত হয়? ম্যাজিক? রিয়েলিটি কি ম্যাজিক নাকি পুরোটাই আমার, পাঠকের এক নিষ্ঠুর স্যাডিস্ট কল্পনা? কতকি হবার ছিল? কমিউনিজমের তাসের ঘর ভেঙ্গে পড়া, অনন্যার চলে যাওয়া, নন্দীগ্রাম এইসব মিলিয়ে একা আমি বসে বসে আজ এই ২০১৪ তে লিখে চলেছি এক খোঁয়াড়ি। এসবই কি হবার ছিল? এটা কি আদৌ মার্কেজের স্মৃতিচারণ হচ্ছে? মার্কেজকে নিয়ে উইকিপিডিয়ায় আর্টিকেলটা বরং অনুবাদ করে দিলে একটা কাজের কাজ হত। যাকগে আঁতেল কাগজে আবার এইসব আঁতলামি ভালো খাবে এটাওতো inevitable! 
শিব ও শক্তির খেলা অনুসারে, সমস্ত ঘটনা, বস্তু, জীবসকল সবই অদ্বৈত ব্রম্ভের ভেদমাত্র। একদিকে কালরূপে জীবাণুসকল সঞ্চয় করা হইতেছে, অপরদিকে চৈতন্যরূপে উহাদিগকে অনাদি নিদ্রা হইতে জাগান হইতেছে। কালের খেলার সঙ্গে যেমন চৈতন্যের যোগ আছে, তেমনই চৈতন্যের খেলার সঙ্গেও কালের যোগ আছে। কালের খেলা নিগ্রহ, চৈতন্যের খেলা অনুগ্রহ। চৈতন্যের প্রভাবে অনাদি সুষুপ্তি হইতে জীব জাগিয়া  উঠে সত্য, কিন্তু একসঙ্গে সব জীব জাগে না, ক্রমশ: জাগে। ইহাই চৈতন্যের উপর কালের প্রভাব। তান্ত্রিক সাধনা ও সিদ্ধান্ত, গোপীনাথ কবিরাজ।

    Ø

লেখাটা এরকম কেন? বয়ানের সম্পাদক আমাকে ইন্দ্রনীলদা বলে ডাকে আর তার সুযোগ নিয়ে আমি যাতা একটা ছাপিয়ে নেব যে _লের লেখা পৃথিবীর অন্য কোথাও ছাপা হবে না! মার্কেজকে জয়দীপ দেখতে চেয়েছে পাঠকের চোখ দিয়ে পাঠকের ওপর মার্কেজের প্রভাব। অর্থাৎ মার্কেজকে যদি একটা ড্রাগ ধরি আর নিজেকে যদি তৃতীয় বিশ্বের এক আদর্শ গিনিপিগ স্যাম্পেল ধরি তাহলে আমার ওপর মার্কেজের প্রভাব। কিন্তু আমার ওপর তো শুধু মার্কেজের প্রভাবই কাজ করেনা আরো আরো অনেক অনেক ভাবনাও কাজ করে। এই লেখাটা লিখতে গিয়ে যে ভাবনা আমাকে ভাবিয়েছে সেটা হলো জ্যাক দেরিদার This strange Institution called Literatureদেরিদা বুদ্ধি দিচ্ছেন লিটারেচারের আড়ালে চলে যাও তাহলে অনেক চাপ কম। লিটারেচার মানে অবাধ লাইসেন্স যা খুশি বলার। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সমস্ত রকম সেন্সরশিপের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া। অতএব গিনিপিগ নিজেই একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে পারে যদি সে লিটারেচারের আড়ালে চলে যায়। কিন্তু মার্কেজ সংখ্যা মান না মান ম্যায় তেরা মেহমান। পাঠক বদ্ধপরিকর সে একটি প্রবন্ধ পড়ছে ... ফালতু বাওয়াল করে লাভ নেইআর যাই হোক এটা কোনো প্রবন্ধ না।
কিন্তু এধরনের লেখাকে কোন গোত্রভূক্ত করা চলে? এটাকে কি দর্শন বলা চলতে পারে মানে মার্কেজের দর্শন ও .... ইত্যাদি আর কি? Philosophy also seemed more political, let’s say, more capable of posing politically the question of literature with the political seriousness and consequentiality it requires.
হুমম বোঝা গেল। না পলিতিকাল নেখা নেখার কোনো ইচ্ছে তো নেইই কিন্তু ভাববার বিষয় এই যে পাঠক আবার এই লেখাটা কোনোরকমে Philosophy গোত্রভুক্ত করে ফেলবে নাতো? সাধু সাবধান! তাহলে উপায়? উপায় আচে, আচে দেরিদা কইয়া গেছেন....
সমস্ত ড্রাগ মিলিতভাবে গিনিপিগের প্রতিক্রিয়া ঠিক করে। শেষ বিচারে তাই গিনিপিগের প্রতিক্রিয়া কেবলমাত্র তার নিজের কথা, আত্মজীবনীযে অমৃত সেই গিনিপিগের কাছে বিষ হয়ে দেখা দিয়েছিল তাকে সাধারণীকরণ (generalize) করলে পাঠক নিজ দায়িত্বে করবেন। আমার কোনো দায় নেই। এ-লেখা একেবারেই আত্মজীবণীমুলক আমাকে আর মার্কেজকে ঘিরে। আমরা যেন দাঁড়িয়ে আছি একই বৃত্তের মধ্যে কখনো কেন্দ্রে মার্কেজ আর পরিধিতে আমি বা কখনো উল্টোটা- কেন্দ্রে আমি আর মার্কেজ পরিধিতে। 

              Ø

সন ২০১৪: আপাতত আমার কথা প্রায় শেষ। কিন্তু শেষটা কি? রিয়েলিটি? ম্যাজিক? নাকি ম্যাজিক রিয়েলিটি? গিনিপিগ এখন বেশ ভালো আছে। তাকে যথাসময়ে যথাবিহিত কমপ্লিমেন্টারি এবং সাপ্লিমেন্টারি ড্রাগ নিয়মিতভাবে দেওয়ার ফলে সে এখন পরবর্তী পরীক্ষার সাবজেক্ট হিসাবে ভালোই আছে।
অনন্যা আমাকে ছেড়ে যায়নি, প্রকৃতির হাতে আমি, (যে আমি দলবদ্ধ আমরা গিনিপিগের একটি গিনিপিগ) নিজেকে দিতে পারিনি। আমাদের বিপ্লবে তখন বা হয়তো এখনো Fermina Daza র কোনো জায়গা নেই। পুরুষ প্রকৃতিকে ব্যবহার করবে, তার সমস্যা তার সমগ্র পুরুষজাতির সমবন্টনে প্রকৃতির সাথে প্রেম তার কাছে নিতান্তই একটা হেডেক-মাত্র। অথবা পুরোটাই একটা নিষ্ঠুর inevitable খেলা। গিনিপিগ তার নিজের অবস্থানে থেকে তার কর্তার ইচ্ছাকে নিশ্চিতভাবে জানতে পারেনা। ১৯৮৫র পর জীবন চলে গেছে কুড়ি কুড়ি বছরের পার... এসময়ে কি মনে হত?
লাভ ইন দা টাইম অফ কলেরা-র শেষ অংশে...
Florentino Ariza, for his part, suddenly asked himself what he would never dared to ask himself before: what kind of secret life had she led outside her marriage? Nothing would have surprised him, because he knew that woman are just like men in their secret adventures: the same stratagems, the same sudden inspirations, the same betrayal without remorse.
অনন্যার সাথে অনেকদিন দেখা নেই। বিয়ের পর ওর প্রথম জন্মদিনে শেষ চিঠিটা দিয়েছিলাম তারপর থেকে ব্ল্যাক আউট। ভাগ্যিস ব্ল্যাক আউট! নয়তো এই লেখাটা লিখতেই পারতাম না। ফেবু, অরকুট, নোকিয়া এবং আরো অনেককে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাদের কানেক্ট করে এই গল্পটার পুটকি ইয়ে না করার জন্য। কেননা এখনো সময় হয় নি
লাভ ইন দা টাইম অফ কলেরা-র একদম শেষ লাইনকটা এই রকম -
“And how long do you think we can keep up this goddamn coming and going?” he asked.
Florentina Ariza had kept his answer ready for fifty-three years, seven months, and eleven days and nights.
“Forever” he said.     
যতক্ষন আমি আমার গিনিপিগত্বকে চ্যালেন্জ না করছি, ততক্ষন কোনো আদর্শ বা কোনো তত্ত্ব বা কোনো ধারনাতে আমার বিশ্বাস বা অবিশ্বাস ঘোষনা করা বা না করা একদমই পালং শাকের ক্যাশমেমো। সুতরাং আমার কোনো দায় নেই কোথাও শুধুমাত্র উপন্যাসের প্রথম লাইনের প্রতি ছাড়া।   


কুলার্ণবতন্ত্রে, পরম পুরুষ শিব প্রকৃতিকে বলছেন, হে কুলনায়িকা, শচী-ইন্দ্র, রোহিনী-চন্দ্র, স্বাহা-অগ্নি, প্রভা-রবি, লক্ষী-নারায়ন, বাণী-ব্রম্ভা, রাত্রি-দিবস, অগ্নি-সোম, বিন্দু-নাদ, প্রকৃতি-পুরুষ, আধার-আধেয়, ভোগ-মোক্ষ, প্রাণ-অপান, বাক্-অর্থ, বিধি-নিষেধ, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি যে যে যুগ্ম যেমন দৃষ্ট বা শ্রুত হয় সে সবই নিঃশংসয় তুমি এবং আমি